ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হারলে মনে হয় আমি ক্ষুধার্ত আর জিতলে মনে হয় পেট ভরে নি: রোনালদো

খেলা ডেস্ক . ২৪আপডেট নিউজ
২০১৮ জুন ২৪ ২০:০৬:৪৪
হারলে মনে হয় আমি ক্ষুধার্ত আর জিতলে মনে হয় পেট ভরে নি: রোনালদো

তখন মাত্রই আমি সত্যিকার ফুটবল খেলা শুরু করেছি। মাদিরার রাস্তায় বন্ধুদের সঙ্গে খেলতাম। রাস্তা বলতে আমি কিন্তু একটা ফাঁকা, পরিত্যক্ত রাস্তা বোঝাচ্ছি না। সত্যিকার অর্থেই—একটা রাস্তা। আমাদের খেলায় গোল বলে কিছু ছিল না। রেফারির বাঁশির শব্দে নয়, হঠাৎ কোনো গাড়ি এলে খেলায় বিরতি পড়ত। প্রতিদিন এই করে বেশ আনন্দেই সময় কাটছিল। আমি খুশি ছিলাম। কিন্তু আমার বাবা এতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি চেয়েছিলেন, আমি যেন মাঠে গিয়ে তরুণ দলের সঙ্গে খেলি। জানতাম, আমি ভালো খেললে তিনি গর্বিত হবেন। অতএব আমার পথচলা শুরু হলো।

প্রথম দিন অনেক নিয়মই বুঝতে পারছিলাম না; কিন্তু ভালো লাগছিল। জয়ের নেশা আমাকে পেয়ে বসেছিল। বাবা প্রতি ম্যাচেই সাইড লাইনে বসে থাকতেন, তিনি আমার খেলা ভালোবাসতেন। কিন্তু আমার মা আর বোনের ফুটবল নিয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না। অতএব প্রতি রাতেই বাবা তাঁদের আমার খেলা দেখতে উৎসাহিত করার চেষ্টা করতেন; যেন তিনি আমার প্রথম ‘এজেন্ট’! মনে আছে বাড়ি ফিরেই বাবা বলতেন, ‘ক্রিস্টিয়ানো আজকে একটা গোল করেছে!’

তারা নিরুত্তাপ গলায় বলত, ‘ভালো।’

পরদিন বাড়ি ফিরে বাবা আবার বলতেন, ‘ক্রিস্টিয়ানো আজ দুটো গোল করেছে!’

সেই একই নিরুত্তাপ কণ্ঠস্বর, ‘খুব ভালো ক্রিস।’

একের পর এক গোল করে যাওয়া ছাড়া আমার কিছু করার ছিল না।

এক রাতে বাড়ি ফিরে বাবা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘ক্রিস্টিয়ানো আজ তিন গোল করেছে! এটা অবিশ্বাস্য! তোমাদের ওর খেলা দেখা উচিত!’

পরদিনও সাইড লাইনে দেখলাম বাবাকে, একা। তারপর একদিন…দৃশ্যটা আমি কখনো ভুলব না…আমি তখন খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, দেখলাম মাঠের পাশে একটা বেঞ্চে আমার মা আর বোন একসঙ্গে বসে আছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল…কীভাবে বলি? মনে হচ্ছিল, তারা খুব আরাম করে বসেছে। বেশ গুটিসুটি মেরে। তারা তালি দিচ্ছিল না, চিৎকার করছিল না। আমাকে দেখে এমনভাবে হাত নাড়ল, যেন আমি একটা কুচকাওয়াজে অংশ নিচ্ছি। মোট কথা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ওরা জীবনে কখনো ফুটবল ম্যাচ দেখেনি। কিন্তু তারা যে এসেছিল, এটাই আমার কাছে সব।

সেই মুহূর্তে ভীষণ ভালো লাগছিল। যেন আমার ভেতরে একটা মোচড় অনুভব করলাম। তখন আমাদের তেমন টাকাপয়সা ছিল না। জীবন ছিল একটা যুদ্ধ। বড় ভাই কিংবা কাজিনরা যেই পুরোনো জুতোগুলো আমাকে দিত, সেগুলো পরে খেলতাম। ছেলেবেলায় মানুষ টাকাপয়সা নিয়ে ভাবে না, সে বয়সে আনন্দটাই সব। সেই দিনগুলোতে আমি মনের খুব গভীর থেকে আনন্দ টের পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল আমার কোনো ভয় নেই, কিছু মানুষের ভালোবাসা আমার সঙ্গে আছে। পর্তুগিজ ভাষায় আমরা বলি, ‘মেনিনো কুয়েরিদো দা ফ্যামিলিয়া।’

ঘটনাটা মনে পড়লে আজও স্মৃতিকাতর হই। কারণ, মনে হয় জীবনের সেই মুহূর্তগুলো খুব দ্রুত চলে গেছে। ফুটবল আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। কিন্তু এই ফুটবলই আমাকে বাড়ি থেকে অনেক দূরে নিয়ে গেছে, আমি পুরোপুরি তৈরি হওয়ার আগেই। ১১ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে স্পোর্টিং লিসবোন একাডেমিতে চলে আসি। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়।

এখন ভাবলে অবিশ্বাস্য মনে হয়। আমার সন্তান ক্রিস্টিয়ানো জুনিয়রের বয়স সাত। এখন লেখার সময় বুঝতে পারছি। আজকে যদি ও প্যারিস বা লন্ডন চলে যাবে বলে আমাকে ওর ব্যাগ গুছিয়ে দিতে হতো, সেই মুহূর্তে আমার কেমন লাগত! আমার কাছে এটা অসম্ভব মনে হয়। আমি নিশ্চিত, আমার মা-বাবার কাছেও এটা অসম্ভব মনে হয়েছিল।

স্বপ্নকে গুরুত্ব দেওয়ার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। অতএব তাঁরা আমাকে যেতে দিয়েছিলেন। প্রায় প্রতিদিনই কাঁদতাম। আমি পর্তুগালেই ছিলাম, অথচ মনে হতো আমি একটা অন্য দেশে চলে এসেছি। আশপাশের মানুষের উচ্চারণ শুনে মনে হতো, তারা যেন সম্পূর্ণ একটা অন্য ভাষায় কথা বলছে। সংস্কৃতিটা ভিন্ন ছিল। কাউকে চিনতাম না। খুব একা লাগত। আমার পরিবারের যা সামর্থ্য, তাতে চার মাসে একবারের বেশি আমাকে দেখতে আসা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। বাড়ির মানুষগুলোকে এত বেশি মিস করতাম যে, প্রতিটা দিন অসহ্য মনে হতো।

সে সময় ফুটবলই আমাকে কষ্ট ভুলে থাকতে সাহায্য করেছে। মাঠে আমি যেভাবে খেলছি, একাডেমির অনেক ছেলেমেয়েই আমার মতো পারে না, এ বিষয়টা আমি বুঝতাম। এখনো মনে আছে, আমার সতীর্থ একটা ছেলে আরেকটা ছেলেকে বলছিল, ‘ও কীভাবে খেলে দেখেছ? যেন একটা জানোয়ার!’

এসব শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। এমনকি কখনো কখনো কোচরাও বলতেন। আবার এ কথাও শুনতে হতো, ‘বটে…তবে ও একেবারেই বাচ্চা।’

সত্যি। আমি খুব শুকনা ছিলাম। সুগঠিত পেশি ছিল না। অতএব ১১ বছর বয়সেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। জানতাম আমার মেধা আছে, কিন্তু আমি অন্য সবার চেয়ে বেশি পরিশ্রম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ঠিক করেছিলাম, আমি ছোট হতে পারি, কিন্তু আমি ছোটদের মতো খেলব না। আমি যেন পৃথিবীর সেরা হতে পারি, সেভাবেই নিজেকে তৈরি করতে শুরু করলাম।

জানি না কোথা থেকে এই জেদ আমার মাথায় ভর করেছিল। এটা এমন এক ক্ষুধা, যা কখনোই নিবারণ হয় না। হেরে গেলে মনে হয় আমি ক্ষুধার্ত। এমনকি জিতলেও মনে হয় পেট ভরেনি।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ



রে