ঢাকা, শুক্রবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২১ ভাদ্র ১৪৩২

MD Zamirul Islam

Senior Reporter

১৫ বছরে ব্যাংক লুটের মহোৎসব: কারা জড়িত, কার কত টাকা?

শেয়ারনিউজ ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ সেপ্টেম্বর ০৫ ১৯:১৩:১৩
১৫ বছরে ব্যাংক লুটের মহোৎসব: কারা জড়িত, কার কত টাকা?

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত গত দেড় দশক ধরে নজিরবিহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের শিকার হয়েছে, যা দেশের আর্থিক ব্যবস্থাকে এক ভয়াবহ সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, ক্ষমতাশীল দলের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, আমলা এবং ব্যাংকারদের যোগসাজশে কমপক্ষে ১১টি ব্যাংক জিম্মি করে বিপুল পরিমাণ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এই ঋণের একটি বিরাট অংশ বর্তমানে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত।

৫ লক্ষ কোটি টাকার জালিয়াতি: কারা এর পেছনে?

এই সময়ের মধ্যে প্রায় ৫ লক্ষ কোটি টাকার জালিয়াতিপূর্ণ লেনদেন সংঘটিত হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, এন্যান টেক্স, ক্রিসেন্ট, বিসমিল্লাহ, এস আলম, বেক্সিমকো, সিকদার, ওরিয়ন, নাসা এবং নাবিল-এর মতো প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলো। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে ২ লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে, যার মধ্যে ১ লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। এই মুহূর্তে এস আলম গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া, বেক্সিমকো গ্রুপের খেলাপি ঋণ ২০ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা এবং সিকদার গ্রুপের ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এই ব্যাপক লুটপাটের কারণে দেশের সাধারণ মানুষই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

তারল্য সংকট ও মূলধন শূন্যতা:

বর্তমানে এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ভয়াবহ তারল্য সংকটে ভুগছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত আমানতের পরিমাণ ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা হলেও, বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১ লক্ষ ৯০ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ১ লক্ষ ৪৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এর ফলস্বরূপ, এই ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত মূলধনে ৪৫ হাজার ২০৩ কোটি টাকার বিশাল ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

খেলাপি ঋণের বিস্ফোরক বৃদ্ধি:

খেলাপি ঋণের চিত্রটি আরও উদ্বেগজনক। ২০২০ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৬ হাজার ১২০ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালে ১ লক্ষ ৫৬ হাজার কোটিতে পৌঁছায়। ২০২৪ সালে তা বেড়ে ৩ লক্ষ ৪৬ হাজার কোটি টাকা হয় এবং চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এই অঙ্ক ৪ লক্ষ ২০ হাজার কোটিতে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে, ব্যাংক খাতের প্রভিশন ঘাটতি ১ লক্ষ ৭১ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা আর্থিক খাতের দুর্বলতাকে প্রকট করে তুলেছে।

ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের হাহাকার:

এই নৈরাজ্যের সরাসরি শিকার হয়েছেন হাজার হাজার সাধারণ গ্রাহক। বহু মানুষ তাদের কষ্টার্জিত অর্থ ফেরত না পেয়ে দিশেহারা। কেউ ধারদেনা করে সংসার চালাচ্ছেন, আবার অনেকে ব্যাংকের দরজায় ঘুরে শুধু হতাশাই পাচ্ছেন। গ্রাহকদের আস্থা তলানিতে ঠেকেছে, যা আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি।

অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারের পথে:

গত ৫ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণকারী নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক খাত সংস্কারে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে, এবং খাতকে স্থিতিশীল করতে ৫২ হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি, ব্যাংক একীভূতকরণের মাধ্যমে খাতকে সুসংহত করার চেষ্টা চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্পষ্ট জানিয়েছে, যেসব ব্যাংক আর্থিক মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ হবে, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে একীভূত করা হবে।

বিশেষজ্ঞদের কঠোর বার্তা:

সাবেক গভর্নর ও বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমদ এই সংকটকে "দীর্ঘ ১৫ বছরের ধারাবাহিক লুটপাট এবং রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে ঋণ বিতরণের ফল" হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, "ব্যাংক খাতের প্রায় ৮০ শতাংশ অর্থ লোপাট হয়েছে।" আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, এই খাতকে পুনর্গঠিত করতে প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

সামনের পথ:

বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূতকরণ, দুর্নীতি দমন এবং কঠোর নজরদারির মাধ্যমে ব্যাংক খাতকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে। তবে গ্রাহকদের হারানো আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং পুরো ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা আনতে আরও স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ অপরিহার্য। এই পদক্ষেপগুলোই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের ভবিষ্যৎ গতিপথ।

তানভির ইসলাম/

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ