ঢাকা, বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৯ আশ্বিন ১৪৩২

MD Zamirul Islam

Senior Reporter

পোশাক খাত সংকটে: ৭২% কোম্পানি লোকসানে, বিনিয়োগকারীরা হতাশ

শেয়ারনিউজ ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ সেপ্টেম্বর ২৪ ১২:১৯:১৩
পোশাক খাত সংকটে: ৭২% কোম্পানি লোকসানে, বিনিয়োগকারীরা হতাশ

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তৈরি পোশাক (আরএমজি) ও টেক্সটাইল খাত একসময় ছিলো সোনালী দিগন্তের প্রতীক। দেশের সিংহভাগ রপ্তানি আয় এবং লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান এই খাতের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এই খাতটি গভীর সংকটে নিমজ্জিত হচ্ছে, যার প্রভাব পড়েছে দেশের শেয়ারবাজার থেকে শুরু করে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের চিত্রেও। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, এই খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর এক বিরাট অংশ লোকসানের বৃত্তে আটকা পড়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থায় বড়সড় চিড় ধরাচ্ছে।

শেয়ারবাজারে ধুঁকছে অধিকাংশ পোশাক ও বস্ত্র কোম্পানি

ডিএসই-তে তালিকাভুক্ত ৫৮টি বস্ত্র ও পোশাক কোম্পানির মধ্যে বর্তমানে ৭২ শতাংশেরও বেশি প্রতিষ্ঠান আর্থিক সংকটে ভুগছে। এর মধ্যে ২৫টি কোম্পানিকে 'জাঙ্ক স্টক' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা তাদের চরম দুর্বল আর্থিক অবস্থাকে নির্দেশ করে। এছাড়া, আরও ১৭টি কোম্পানি 'বি' ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, অর্থাৎ তারা নিয়মিত লভ্যাংশ প্রদানে ব্যর্থ। এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, একসময়কার শক্তিশালী এই খাতটি এখন শেয়ারবাজারে তার জৌলুস হারাচ্ছে, এবং বিনিয়োগকারীরা এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

খেলাপি ঋণের ভারে ন্যুব্জ গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল

বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৪ সালের ফিনান্সিয়াল স্টেবিলিটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে এক alarming চিত্র। প্রতিবেদন অনুযায়ী, পোশাক খাতে খেলাপি ঋণের (এনপিএল) হার ২৬ শতাংশে পৌঁছেছে, আর টেক্সটাইল খাতে এটি ২৫ শতাংশ। এই দুটি খাতই দেশের অন্যান্য প্রধান শিল্পের তুলনায় খেলাপি ঋণে শীর্ষে অবস্থান করছে। তুলনামূলকভাবে, ফার্মাসিউটিক্যালস (৬%), কৃষি (১১%) এবং আবাসন (১২%) খাতের খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্যভাবে কম। যদিও চামড়া শিল্প ও জাহাজ নির্মাণ খাত যথাক্রমে ৩৯% খেলাপি ঋণ নিয়ে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে, তবে অর্থনীতির মূল ভিত্তি হিসেবে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইলের এই অবস্থা সার্বিক আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকার লড়াই

খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, বড় প্রতিষ্ঠানগুলো কোনোমতে টিকে থাকলেও ছোট ও মাঝারি আকারের কোম্পানিগুলোই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কোভিড-১৯ এর প্রভাব থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসার আগেই বৈশ্বিক মন্দা, উচ্চ জ্বালানি খরচ এবং বিদ্যুৎ-গ্যাসের সরবরাহ সংকট তাদের মুনাফাকে মারাত্মকভাবে কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে অনেক ছোট কারখানা ঋণের উপর অত্যধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, যা তাদের টিকে থাকাকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে।

বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা এবং বাজারের স্থবিরতা

ডিএসইর তথ্যানুসারে, বস্ত্র ও পোশাক খাতের অনেক কোম্পানি টানা কয়েক বছর ধরে শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ড দিতে পারছে না। এই বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের মনে গভীর হতাশা তৈরি করেছে এবং তাদের আস্থা তলানিতে ঠেকেছে। যখন একটি খাতের ৭২ শতাংশ কোম্পানি মুনাফা অর্জন করতে বা কাঙ্ক্ষিত লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ হয়, তখন বাজারে সেই খাতের শেয়ার কেনাবেচার গতি কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক। এর নেতিবাচক প্রভাব পুরো শেয়ারবাজারের গতিশীলতাকেই বাধাগ্রস্ত করছে।

তবুও সম্ভাবনার আলো ও উত্তরণের পথ

এই কঠিন পরিস্থিতি সত্ত্বেও, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে বাংলাদেশের পোশাক খাতের দীর্ঘমেয়াদী সম্ভাবনা এখনও প্রবল। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশ আসে এই খাত থেকে এবং এটি প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে, যার ৬০ শতাংশেরও বেশি নারী শ্রমিক।

পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ এই সংকট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, দেশের প্রধান রপ্তানি খাত দুর্বল হলে তা কেবল শেয়ারবাজার নয়, কর্মসংস্থান ও রপ্তানি আয়ের ওপরও সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তার মতে, "অসুস্থ কোম্পানিগুলোর জন্য একটি 'নিষ্ক্রমণ নীতি' (Exit Policy) প্রয়োজন, এবং কিছু প্রতিষ্ঠানকে পুনর্গঠন করে প্রতিযোগিতার বাজারে ফিরিয়ে আনতে হবে।" তিনি আরও জোর দেন, যে কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে টেকসই মুনাফা করছে, তাদের মতো সফল প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এর জন্য খাতভিত্তিক সুনির্দিষ্ট নীতি, সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা এবং নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল খাত বর্তমানে যে গভীর সংকটের মুখোমুখি, তা মোকাবিলায় অবিলম্বে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এই খাতকে পুনরায় শক্তিশালী করতে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং দেশের অর্থনীতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে। এই সংকটের সমাধান কেবল পোশাক খাতের জন্যই নয়, বরং বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির জন্যও অপরিহার্য।

আব্দুর রহিম/

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ