ঢাকা, শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৫, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

Alamin Islam

Senior Reporter

ভূমিকম্প সুরক্ষা: কোরআন, হাদিস ও বিজ্ঞান কী বলে? করণীয় জানুন

ধর্ম ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ নভেম্বর ২৮ ১১:০৩:৩১
ভূমিকম্প সুরক্ষা: কোরআন, হাদিস ও বিজ্ঞান কী বলে? করণীয় জানুন

সাম্প্রতিককালের ভূকম্পন জনমনে প্রলয়ের ভয় ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের অসীম পরাক্রমের স্মৃতি জাগিয়ে তুলেছে। ভূ-তত্ত্ববিদরা এই ঝাঁকুনিগুলোকে পৃথিবীর অভ্যন্তরের টেকটনিক প্লেটগুলোর নিত্যকার সংঘর্ষের ফল হিসেবে চিহ্নিত করলেও, একজন বিশ্বাসীর কাছে এটি কেবল ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া নয়; বরং ইমান পরীক্ষার এক গভীর সংকেত এবং মানবজাতির প্রতি এক গুরুতর সতর্কবার্তা।

এই বিশেষ প্রতিবেদনে, পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ও রাসূলের নির্দেশনা এবং আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ভূমিকম্পের উৎস এবং এর ভয়াবহতা থেকে পরিত্রাণের কার্যকর উপায় বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

আসমানী দৃষ্টিতে ভূকম্পনের মূল কারণ

ইসলামিক দর্শন অনুসারে, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মূলে রয়েছে মহান আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ এবং মানবজাতির কৃতকর্মের ফল।

১. পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআনের ঘোষণা

সর্বশক্তিমানের নিয়ন্ত্রণ ও কিয়ামতের ইঙ্গিত: পবিত্র কুরআনের একাধিক আয়াতে আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির ওপর চরম কর্তৃত্ব ঘোষণা করেছেন। এই ক্ষমতা প্রকাশের এক মাধ্যম হলো ভূমিকম্প, যা মহাপ্রলয় বা কিয়ামতের অত্যাসন্নতার সংকেত দেয়। আল্লাহ্ পাক ঘোষণা করেন, ‘হে মানবকুল, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো। নিঃসন্দেহে কিয়ামতের প্রকম্পন হবে এক মহাভীতিকর ঘটনা।’ (সূরা আল হাজ্জ-২২ : আয়াত-১)।

ধরিত্রীর নিজস্ব জবানবন্দি: আল্লাহর আদেশ ব্যতিরেকে কোনো প্রাকৃতিক শক্তি ক্রিয়াশীল হতে পারে না। এই প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামিন বলছেন, ‘যখন পৃথিবী তার চরম কম্পনে আন্দোলিত হবে, এবং অভ্যন্তরের যাবতীয় বোঝা নির্গত করে দেবে। আর মানুষ বিস্ময়ে জানতে চাইবে, এর কী ঘটল? সেদিন জমিন তার সব ইতিহাস ব্যক্ত করবে। কারণ আপনার পালনকর্তা তাকেই আদেশ করবেন।’ (সূরা আঝ যিলযাল-৯৯ : আয়াত-১ থেকে ৫)।

মানবীয় ত্রুটির পরিণতি: ইসলামিক দর্শন অনুসারে, বেশিরভাগ প্রাকৃতিক বিপর্যয় মানুষের নৈতিক স্খলন, পাপ এবং সীমালঙ্ঘনের ফল। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তোমাদের ওপর যা-ই বিপদ আসে, তা তোমাদের হাতের কামাইয়ের ফল। আর তিনি তোমাদের বহু অপরাধ এড়িয়ে যান।’ (সূরা আশ শুরা-৪২ : আয়াত-৩০)।

২. নবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী ও সতর্কবাণী

রাসূলুল্লাহ (সা.) কিয়ামতের পূর্বলক্ষণ হিসেবে কম্পনের আধিক্যকে উল্লেখ করেছেন। যখন সমাজে অপরাধ ও পাপের প্রাচুর্য দেখা যায়, তখন আল্লাহ মানবজাতিকে সচেতন করার জন্য এই প্রলয় সৃষ্টি করেন। রাসূল (সা.) বলেন, ‘জ্ঞান বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, ভূমিকম্পের তীব্রতা না বাড়লে, সময় দ্রুত ফুরিয়ে না গেলে, বিশৃঙ্খলা বা ফিতনা ছড়িয়ে না পড়লে এবং রক্তপাত বৃদ্ধি না পেলে কিয়ামত সংঘটিত হবে না।’ (বুখারি : ১০৩৬)।

ইমানী ঢাল: প্রলয় থেকে মুক্তির আধ্যাত্মিক উপায়

যেহেতু বিপর্যয় আমাদের কৃতকর্মের ফল, তাই একজন মুমিনের জন্য এ মুহূর্তে একমাত্র পরিত্রাণ হলো ইমানী আমলের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা:

সর্বাধিক অনুশোচনা (ইস্তিগফার): আল্লাহর কাছে বিপুল পরিমাণে পাপের মুক্তি চাওয়া আবশ্যক। রাসূল (সা.) জানিয়েছেন, নিয়মিত ক্ষমা প্রার্থনাকারীকে আল্লাহ সকল বিপদ-মুসিবত থেকে মুক্ত রাখেন। (সুনান আবু দাউদ : ১৫১৮)।

আল্লাহর উপর দৃঢ় আস্থা (তাওয়াক্কুল): দুর্যোগের ক্ষণে একজন বিশ্বাসীর জন্য অপরিহার্য হলো চরম ধৈর্য ধারণ করা এবং সৃষ্টিকর্তার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখা। আল্লাহ পবিত্র গ্রন্থে অঙ্গীকার করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সহিষ্ণুদের সাথে থাকেন।’ (সূরা আল বাকারাহ-২ : আয়াত-১৫৩)।

নবীজীর (সা.) প্রতি দরুদ বৃদ্ধি: আমাদের প্রিয় নবী (সা.) সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য দয়া। তাঁর প্রতি অধিক দরুদ পাঠ করলে আল্লাহ নিজ করুণা বর্ষণ করেন। রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে আমার ওপর একবার দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ তার ওপর দশবার রহমত নাযিল করেন।’ (সুনান আন নাসাঈ : ১২৯৮)। যেখানে আল্লাহর করুণা বিদ্যমান, সেখানে আযাব থাকতে পারে না।

নামাজের আশ্রয় গ্রহণ: নামাজ হলো বান্দা ও আল্লাহর মধ্যে যোগাযোগের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। বর্তমান ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে ফরয সালাতের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে নফল নামাজ আদায় করে আল্লাহর অনুগ্রহ কামনা করা উচিত। আল্লাহ নিজেই বিপদের সময় ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাইতে নির্দেশ দিয়েছেন। (সূরা আল বাকারাহ-২ : আয়াত-১৫৩)।

বিপদ মুক্তির বিশেষ প্রার্থনা (দোয়া): ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দুর্যোগের সময় পাঠের জন্য দোয়ায়ে ইউনূস একটি প্রসিদ্ধ আমল।

দোয়ায়ে ইউনূস: ‘লা ইলা-হা ইল্লা আনতা সুবহা-নাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন।’ অর্থাৎ : ‘(হে আল্লাহ!) তুমি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই; তুমি পবিত্র, মহান! আমি তো সীমালঙ্ঘনকারী।’ (সূরা আল আম্বিয়া-২১ : আয়াত-৮৭)।

রাসূল (সা.)-এর দোয়া: বিপদকালীন মুহূর্তে আল্লাহর রাসূল (সা.) পাঠ করতেন: ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহুল আজিমুল হালিম, লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু রাব্বুল আরশিল আজিম, লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু রাব্বুস সামা-ওয়া-তি ওয়া রাব্বুল আরদ্বি ওয়া রাব্বুল আরশিল কারীম।’ (মুসলিম : ২৭৩০)।

দানশীলতা (সাদাকাহ): আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং বিপর্যয় থেকে রক্ষায় অন্যতম কার্যকর আমল হলো দান-সাদাকাহ। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সাদাকাহ আল্লাহর ক্রোধকে শান্ত করে এবং অপমৃত্যু প্রতিরোধ করে।’ (তিরমিযি : ৬৬১)।

আধুনিক সুরক্ষা: ভূমিকম্প মোকাবিলায় বিজ্ঞানসম্মত পদক্ষেপ

ধর্মীয় বিশ্বাসের পাশাপাশি, মানুষের জীবনের সম্ভাব্য ঝুঁকি কমাতে বিজ্ঞান ও প্রকৌশলসম্মত প্রস্তুতি অপরিহার্য।

কাঠামোগত নিরাপত্তা ও দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতি

প্রকৌশল বিধিমালা অনুসরণ: নতুন ভবন নির্মাণে অবশ্যই কম্পন-সহনশীল প্রকৌশল বিধিমালা কঠোরভাবে প্রতিপালন করতে হবে।

কাঠামো শক্তিশালীকরণ (রেট্রোফিটিং): পুরোনো ও দুর্বল কাঠামোগুলিকে দ্রুত রেট্রোফিটিং (Retrofitting) বা কাঠামোগত মানোন্নয়নের মাধ্যমে মজবুত করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পদ্ধতি দুর্বল কাঠামোর ক্ষতি ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনতে পারে।

জরুরি কিট (৭২ ঘণ্টা কিট): পরিবারের জন্য পানীয় জল, শুকনা খাবার, প্রাথমিক চিকিৎসার সামগ্রী, টর্চ, বাঁশি, রেডিও এবং গুরুত্বপূর্ণ নথি (জাতীয় পরিচয়পত্র, প্রেসক্রিপশন ইত্যাদি) সমন্বয়ে একটি ‘৭২ ঘণ্টা কিট’ প্রস্তুত রাখা আবশ্যক।

কম্পনের সময় করণীয় (আমেরিকান ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি নির্দেশিত)

ভবনের অভ্যন্তরে থাকলে:

দ্রুত একটি মজবুত ডেস্ক, টেবিল বা বেঞ্চের নিচে আশ্রয় নিন এবং ঝাঁকুনি না থামা পর্যন্ত শক্তভাবে ধরে রাখুন।

আসবাবপত্র না পেলে মাথা ও মুখ হাত দিয়ে ঢেকে ভিতরের দেওয়ালের পাশে বসুন।

জানালা, কাচ, বাইরের দরজা, দেওয়াল ও উঁচু আসবাবপত্র এড়িয়ে চলুন।

সিঁড়ি বা লিফট ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।

বিছানায় থাকলে বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে রাখুন অথবা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে বিছানার পাশে মেঝেতে সরে যান।

তাড়াহুড়ো করে ভবন থেকে বের হওয়ার বা ছাদে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না; কারণ এতে আঘাতের ঝুঁকি বাড়ে।

খোলা জায়গায় থাকলে:

বাইরেই থাকুন।

বিল্ডিং, ল্যাম্পপোস্ট, গাছ ও বিদ্যুতের তার থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যান।

গাড়ির ভেতর থাকলে:

খোলা স্থানে গাড়ি থামিয়ে ভেতরেই থাকুন।

ওভারপাস, বিল্ডিং বা তারের নিচে গাড়ি দাঁড় করাবেন না।

ক্ষতিগ্রস্ত সেতু বা ওভারপাস এড়িয়ে চলুন।

ধ্বংসাবশেষে চাপা পড়লে:

কোনোভাবেই আগুন জ্বালাবেন না।

ধুলো শ্বাসনালিতে প্রবেশ রোধ করতে রুমাল বা কাপড় দিয়ে নাকমুখ ঢেকে নড়াচড়া হ্রাস করুন।

পাইপ বা দেওয়াল চাপ দিয়ে বা হুইসেল ব্যবহার করে উদ্ধারকারীদের মনোযোগ আকর্ষণ করুন।

অত্যন্ত জরুরি না হলে চিৎকার করবেন না; কারণ চিৎকার করার সময় শ্বাসতন্ত্রে ধুলো প্রবেশ করতে পারে।

সম্মিলিত অঙ্গীকার

এই সংকটপূর্ণ সময়ে, ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে আধ্যাত্মিক আমলগুলো পালন করার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সর্বোচ্চ শারীরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের কর্তব্য। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে সাবধানতা অবলম্বন এবং পাশাপাশি দুর্যোগপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমেই আমরা সম্মিলিতভাবে এই বিপর্যয় মোকাবিলা করতে সক্ষম হব। মহান আল্লাহ যেন আমাদের সকল প্রাকৃতিক বিপদাপদ থেকে রক্ষা করেন। আমিন।

আমিনুল ইসলাম/

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ