ঢাকা, সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

Alamin Islam

Senior Reporter

হাইকমান্ডের নির্দেশে বিএনপির ৪০ আসনে রদবদল? তালিকা প্রকাশ!

রাজনীতি ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ নভেম্বর ২৪ ১৫:২৩:১৩
হাইকমান্ডের নির্দেশে বিএনপির ৪০ আসনে রদবদল? তালিকা প্রকাশ!

দেশের পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে, বিএনপির ঘোষিত প্রাথমিক মনোনয়ন তালিকা ঘিরে দলীয় অঙ্গনে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দলটির নীতিনির্ধারক মহলকেও বেশ অস্বস্তিতে ফেলেছে। চলমান এই বিভেদ নিরসনে বিদ্রোহ ঘোষণা করা নেতাকর্মীদের গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে তলব করে সংঘাত মেটানোর প্রচেষ্টা চলছে। তবে স্থানীয় নেতাকর্মীদের আশঙ্কা, আসনগুলোতে এই বিরোধ দ্রুত সমাধান না হলে তা দলের জন্য আরও গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

প্রাথমিক প্রার্থী ঘোষণার পরও দলটির তৃণমূল স্তরে কিছু আসনে বিভাজন এখনও স্পষ্ট। এক দিকে, মনোনয়নপ্রাপ্ত নেতারা নির্বাচনী প্রচারণায় অর্থ ব্যয় করছেন; অন্যদিকে, যারা প্রাথমিক মনোনয়ন পাননি, তারাও শেষ মুহূর্তে মনোনয়ন লাভের প্রত্যাশায় অর্থ বিনিয়োগ করছেন। এই বঞ্চিত নেতাদের সমর্থকরা প্রার্থিতা পরিবর্তনের দাবিতে সড়ক অবরোধ, প্রতিবাদ মিছিল এবং জনসভাসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন। এর বিপরীতে, ঘোষিত একক প্রার্থীর সমর্থকরাও পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে সক্রিয়। সার্বিকভাবে, এই পরিস্থিতি কেবল বিএনপির অভ্যন্তরীণ ক্ষতিই করছে না, বরং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দল এই বিভেদের সুযোগ নিয়ে ফায়দা তুলছে।

ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ উপেক্ষিত, বিভেদ গভীর

ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনী মাঠে থাকার বিষয়ে বিএনপির হাইকমান্ড থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকলেও, অভিযোগ উঠেছে যে কিছু আসনের সম্ভাব্য একক প্রার্থী তা মানছেন না। তারা তাদের এলাকায় প্রাথমিক মনোনয়ন না পাওয়া নেতৃবৃন্দের সাথে এখনও কোনো যোগাযোগ করেননি বা সহযোগিতা চেয়ে ফোনও দেননি। প্রার্থীদের এমন গা ছাড়া ভাব অনেক ক্ষেত্রে বিভাজন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে।

দলীয় সূত্রের খবর, আসনভিত্তিক সংঘাতের মূল কারণ, মনোনীতদের দুর্বলতা এবং বঞ্চিত নেতাদের জনসমর্থনের সঠিক অবস্থান নতুন করে মূল্যায়নের জন্য বিএনপির একটি বিশেষ দল কাজ করছে। এই দলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই প্রার্থী তালিকা পুনর্বিবেচনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। দলের বিভিন্ন স্তরের কর্মীরা বলছেন, প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে ভেতরে ক্ষোভ থাকলেও বর্তমানে ঐক্যের সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। বঞ্চিতদের পর্যায়ক্রমে ডেকে এনে তাদের ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করা হচ্ছে এবং দ্রুত এই সংকটের সমাধান হবে বলে তারা আশাবাদী।

তৃণমূলের ক্ষোভ: ৪০ আসনে মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবি

পর্যবেক্ষণে জানা গেছে, ঘোষিত ২৩৬টি আসনের মধ্যে কমপক্ষে ৪০টিতে বিরোধ চলমান। ক্ষুব্ধ মনোনয়নবঞ্চিতরা অভিযোগ করেছেন যে, একক প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা সঠিকভাবে যাচাই করা হয়নি। তাদের ধারণা, জরিপের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা হয়তো বিএনপির হাইকমান্ডকে ভুল তথ্য সরবরাহ করেছেন, যার ফলে বর্তমান বৈরী পরিস্থিতির সৃষ্টি। এই আসনগুলোর সম্ভাব্য প্রার্থী ও বঞ্চিত উভয় পক্ষের নেতারাই প্রতিদিন মাঠে সক্রিয় থাকছেন এবং ধানের শীষের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এতে উভয় পক্ষকেই বিপুল অর্থ ও শ্রম ব্যয় করতে হচ্ছে। দ্রুত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিলে বিরোধের সুযোগ অন্য দলগুলো নিতে পারে বলে তারা সময়ক্ষেপণ না করার আহ্বান জানিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু জানিয়েছেন, দলটি আগেই স্পষ্ট করেছে যে এটি একটি চূড়ান্ত তালিকা নয়, বরং একটি সম্ভাব্য খসড়া। তিনি বলেন, “যদি কোনো এলাকায় পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়, তবে অবশ্যই তা করা হবে। সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেই তালিকা প্রণীত হয়।” তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, অনেক জায়গায় একাধিক যোগ্য নেতা থাকায় মনোনয়ন ঘোষণার পর কিছু জায়গায় ক্ষোভ দেখা দেওয়া স্বাভাবিক, যা তারা আলোচনা করে নিরসন করছেন।

দুর্বল প্রার্থী ও শক্ত বঞ্চিত: যেসব আসনে পরিবর্তনের দাবি তীব্র

জানা গেছে, যেসব আসনে এখনও সংঘাত মেটেনি, সেখানে ঘোষিত অনেক প্রার্থীর অবস্থান স্থানীয় পর্যায়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল। বিপরীতে, মনোনয়নবঞ্চিতরা স্থানীয়ভাবে অধিক শক্তিশালী ও জনপ্রিয়।

নিম্নলিখিত আসনগুলোতে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে জোরালো আন্দোলন চলছে:

চাঁদপুর-২: যুগ্মসাধারণ সম্পাদক তানভীর হুদার সমর্থকরা বিক্ষোভ-সমাবেশ করছেন।

সুনামগঞ্জ-৫: ত্যাগী ও জনপ্রিয় নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরীর পক্ষে প্রতিদিন প্রতিবাদ ও জনসভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

কুষ্টিয়া-১ ও ৪: কুষ্টিয়া-১ এ শরিফ উদ্দিন জুয়েলের সমর্থকরা মানববন্ধন ও গণমিছিল করছেন। কুষ্টিয়া-৪ এ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ সাদী প্রার্থী হতে চাইছেন। স্থানীয়রা মনে করছেন, এই জনপ্রিয় নেতাকে বাদ দিলে গুরুতর রাজনৈতিক বিপর্যয় ঘটতে পারে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪: সাবেক সাংসদ মুশফিকুর রহমানকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও, অপর প্রার্থী কবির আহমদ ভুঁইয়ার সমর্থনে দুই উপজেলার নেতাকর্মীরা নিয়মিত কর্মসূচি পালন করছেন।

নরসিংদী-৪: স্থানীয় নেতাকর্মীদের একটি অংশ ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি আব্দুল কাদির ভুঁইয়া জুয়েলকে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চাইছে।

নাটোর-১: কেন্দ্রীয় সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপুকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবিতে সমাবেশসহ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ-২: এখানে সব মনোনয়নবঞ্চিত একতাবদ্ধ হয়ে কেন্দ্রীয় নেতা মাহমুদুর রহমান সুমনকে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চেয়ে বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল করেছে।

গাইবান্ধা-২, চট্টগ্রাম-১২, ১৩: গাইবান্ধা-২ এ সাবেক সচিব আমিনুল ইসলামকে, চট্টগ্রাম-১২ এ এনামুল হকের মনোনয়নের পর থেকে বিক্ষোভ চলছে। চট্টগ্রাম-১৩ এ সরওয়ার জামাল নিজামের মনোনয়ন হলেও দলের দুঃসময়ের নেতাদের প্রার্থী করার আবেদন জানানো হয়েছে।

এছাড়াও চট্টগ্রাম-৪ ও ১৬, সিলেট-৬, রংপুর-৩, সাতক্ষীরা-২ ও ৩, গাইবান্ধা-৪, ঠাকুরগাঁও-৩, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২, কুড়িগ্রাম-২, নোয়াখালী-৫, নীলফামারী-৪, দিনাজপুর-২, হবিগঞ্জ-৪, জয়পুরহাট-১ ও ২, ময়মনসিংহ-৩, ৬, ৯ ও ১১, মুন্সীগঞ্জ-২, কুমিল্লা-৫, ৬ ও ১০, রাজশাহী-৪ ও ৫, রাজবাড়ী-২, নওগাঁ-১, ৩ ও ৪, পাবনা-৪, মৌলভীবাজার-২ আসনসহ আরও কয়েকটি স্থানে প্রার্থী বাতিলের জন্য আন্দোলন চলছে।

যোগাযোগে উদাসীনতা বনাম ঐক্যের উদ্যোগ

মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাইকমান্ডের ঐক্যের নির্দেশনা সত্ত্বেও কিছু প্রার্থী তা মানছেন না। খুলনা-৪ আসনের মনোনয়নবঞ্চিত নেতা পারভেজ মল্লিক জানান, প্রার্থী তার কাছে সহযোগিতা চাননি। বরিশাল-২ আসনেও একই অভিযোগ, যেখানে প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়া সরফুদ্দিন আহমেদ (সান্টু) সাবেক ছাত্রনেতা দুলাল হোসেন ও সাইফ মাহমুদ জুয়েলের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেননি। উপরন্তু, জুয়েলের পোস্টার-সাইনবোর্ড ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগও উঠেছে।

তবে ব্যতিক্রমী ও ইতিবাচক দৃষ্টান্তও রয়েছে। গাজীপুর-২ আসনের এম মঞ্জুরুল করিম রনি প্রার্থী ঘোষণার পরপরই বঞ্চিত নেতাদের সাথে দেখা করে তাদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নেমেছেন। বরিশাল-৫ আসনে মজিবর রহমান সরোয়ারও মনোনয়ন পাওয়ার পর বঞ্চিত নেতাদের সঙ্গে কথা বলে অতীতের সকল বিভেদ মিটিয়ে সবাইকে একত্রিত করে কর্মসূচি পালন করেছেন।

ঘোষিত আসনগুলোতে প্রার্থী পরিবর্তনের ক্ষমতা কেবল বিএনপির হাইকমান্ড এবং মনোনয়ন বোর্ডের হাতে। চূড়ান্ত তালিকায় এই ৪০টি আসনে বিএনপি কী পরিবর্তন আনে, তা জানতে দলীয় নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষকে অপেক্ষা করতে হবে।

তানভির ইসলাম/

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ