ঢাকা, শনিবার, ৩১ মে ২০২৫, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

১ লাখ ৯০ হাজারের গরু ৭০ হাজারে

সারাদেশ ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ মে ৩০ ২৩:০৬:৩৯
১ লাখ ৯০ হাজারের গরু ৭০ হাজারে

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঠাকুরগাঁওয়ের হাটে যেন জমজমাট ঈদের আমেজ, কোরবানির পশু কেনাবেচায় ব্যস্ততা তুঙ্গে। তবে এই চেনা চিত্রের পেছনে লুকিয়ে আছে ভিন্ন এক বাস্তবতা। গরুর হাটে আজকাল এক ধরনের বৈপরীত্য স্পষ্ট—যেখানে সাধারণ ক্রেতার চোখে হাসি, সেখানে খামারির চোখে ক্লান্তি আর হতাশা।

গরুর হাটে ‘সেল’!

একসময় যে গরুর দাম ছিল এক লাখ ৯০ হাজার, এবার সেই গরু মিলছে মাত্র ৭০-৭৫ হাজার টাকায়। পুরাতন ঠাকুরগাঁওয়ের গরু বিক্রেতা সারোয়ার যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “মানুষের হাতে টাকা নেই। গতবার যে গরু ৯০ হাজারে বিক্রি করেছি, এবার সেটা তুলতে পারলাম না ৭০ হাজারেও।”

রোড এলাকার মো. আব্দুস সোবহান বড় খোঁচাবাড়ি পশুর হাটে গরু কিনে বললেন, “আমার বাজেট ছিল ৭০ হাজার, সেই টাকায়ই পেয়েছি ভালো গরু। আলহামদুলিল্লাহ, খুশি হয়েছি। গরু বিক্রেতা বলছে মাংস হবে ১০০ কেজি, আমি ধরছি ৯০-৯৫ কেজি। তাতেই সন্তুষ্ট।”

খুশির ঈদ, কান্নার হাটএকটা গরু বড় করতে লাগে ৮-১০ মাস। প্রতিদিনের খাবার, রোগবালাই ঠেকানোর ওষুধ, নিয়মিত পরিচর্যা—সব মিলিয়ে যেন একটা খামার নয়, ছোটখাটো যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে জয়ী হয়ে হাটে আসা খামারিরা এখন পরাজিত বোধ করছেন। লাভ তো দূরের কথা, মূলধনটাও উঠছে না কারও কারও।

স্থানীয় খামারি দুলাল বললেন, “লালন-পালনের খরচ তুলতেই হিমশিম খাচ্ছি। এবার গরু পালন করে লস গুনছি।” জাহাঙ্গীর আলম তার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, “যেভাবে দাম পড়েছে, ভবিষ্যতে আর গরু পালাতে সাহস করব না।”

হাটে কাদা-পানি, মনে ক্ষোভ আর প্রশ্ন

হাটে শুধু দামই কম না, সমস্যা আরও অনেক। কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও অতিরিক্ত টোল আদায়। আবার ক্রেতা-বিক্রেতাদের মাঝে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। সরাসরি মালিকের কাছ থেকে গরু কেনাও এখন যেন ভাগ্যের ব্যাপার।

ছাগলের হালও ভালো না। বিক্রেতারা জানাচ্ছেন, গত বছর যে ছাগল ১০ হাজারে বিক্রি হতো, এবার তার দাম ৫-৬ হাজার। মাংসের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়ও না।

বাজারে গরু বেশি, ক্রেতা কম

জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস বলছে, ঠাকুরগাঁওয়ে এবার চাহিদা ৭৫ হাজার কোরবানির পশুর, প্রস্তুত হয়েছে ৯১ হাজার। অতিরিক্ত সরবরাহ আর কমে যাওয়া ক্রয়ক্ষমতা মিলিয়ে বাজারে পড়েছে চাপ। অনেকে আবার আগেই অনলাইন থেকে গরু কিনে নিয়েছেন, ফলে হাটে ক্রেতা সংখ্যা কম।

গরু ব্যবসায়ী জাকির হোসেন বলেন, “ইন্ডিয়ান গরু নেই, তবু দাম পড়ে গেছে। এবার আড়াই থেকে তিন মণের গরুতে ১০ হাজার টাকা কম, ৫-৬ মণের গরুতে কমছে ২০-২৫ হাজার।”

দাম কি আর বাড়বে?

ব্যবসায়ীদের আশাবাদ কম। অনেকে বলছেন, “আবহাওয়া যেমন, বাজার তেমন। বরং শেষ মুহূর্তে দাম আরও কমতে পারে।” এখনো অনেক গ্রামের গরু হাটে ওঠেনি, সেগুলো এলে হয়তো বাজার আরও চাপে পড়বে।

আশার আলো কোথায়?

প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. ইজহার আহমেদ খান জানালেন, “বর্তমানে দাম কম হলেও পাইকাররা বাজারে নামলে দাম বাড়ার সম্ভাবনা আছে। গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সচেতনতা—সব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”

ইউএনও মো. খাইরুল ইসলাম বলেন, “জেলায় ৪০টি হাটে অতিরিক্ত টোল আদায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা নিয়মিত বাজার মনিটরিং করছেন।” তিনি জানান, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতাও বাড়ানো হয়েছে।

ভবিষ্যতের শঙ্কা

একবার লোকসান হলে খামারিরা ফিরে দাঁড়াতে পারেন। কিন্তু বারবার হলে? অনেকেই বলছেন, “এভাবে চললে আমরা গরু পালনই ছেড়ে দেব।” তাতে দেশি পশুর উৎপাদনে সংকট দেখা দিতে পারে—এই শঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা।

ক্রেতাদের হাসিমুখের আড়ালে লুকিয়ে আছে খামারিদের দুশ্চিন্তা। ঈদের আনন্দের এই বাজারে যদি তাদের শ্রমের মূল্য না মেলে, তাহলে আগামী ঈদে হয়তো বাজারে গরু থাকবে, কিন্তু সেই গরুর পেছনে থাকবে না একজন খামারির গল্প। আর ঈদ তো শুধু কোরবানির নয়, এটা তো ভাগাভাগির, সহমর্মিতার উৎসব। তাই এই গল্প আমাদের সকলের।

FAQ (Frequently Asked Questions) + উত্তর

প্রশ্ন ১: ঠাকুরগাঁওয়ে গরুর দাম কমে যাওয়ার কারণ কী?

উত্তর: চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি, মানুষের হাতে নগদ টাকার সংকট এবং কৃষি খাতে লোকসানের প্রভাবেই গরুর দাম কমে গেছে।

প্রশ্ন ২: দাম কমলেও কি গরুর মান ঠিক আছে?

উত্তর: হ্যাঁ, অধিকাংশ দেশি গরুই স্বাস্থ্যবান এবং ভেটেরিনারি টিমের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হচ্ছে।

প্রশ্ন ৩: গরুর দাম আরও কমতে পারে কি?

উত্তর: অনেক খামারি এখনও গরু বাজারে আনেননি। ফলে শেষ সময় দাম আরও কমার আশঙ্কা রয়েছে।

প্রশ্ন ৪: বিক্রেতারা কেন লোকসানে পড়ছেন?

উত্তর: গরু পালনে ৮-১০ মাসের খরচ, ওষুধ ও পরিচর্যার ব্যয় ওঠে না—তাই বিক্রি করে ক্ষতিতে পড়ছেন।

মো: রাজিব আলী/

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ