ঢাকা, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫, ১০ শ্রাবণ ১৪৩২

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিচারক খায়রুল হক গ্রেফতার

রাজনীতি ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ জুলাই ২৬ ০০:২০:৩৪
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিচারক খায়রুল হক গ্রেফতার

নিজস্ব প্রতিবেদক: তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেশে একদলীয় নির্বাচনী ব্যবস্থার পথ সুগমকারী এবং ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে একের পর এক বিতর্কিত রায়দাতা সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক অবশেষে গ্রেফতার হয়েছেন। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় রাজধানীর ধানমন্ডির নিজ বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ডিবির যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম।

শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই ছিলেন নজরদারিতে

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার পর ক্ষমতা হারায় আওয়ামী লীগ। এরপর থেকেই খায়রুল হকসহ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ ও সুবিধাভোগী আমলা, বিচারপতি ও নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে বিভিন্ন সংস্থা। অনেকে আত্মগোপনে চলে গেলেও খায়রুল হকের অবস্থান ছিল দীর্ঘদিন অস্পষ্ট। সম্প্রতি তার নামে বিভিন্ন দুর্নীতির অনুসন্ধানে গতি পায় দুদক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের ‘প্রধান রচয়িতা’

২০১১ সালে প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায় একটি মামলার রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেন খায়রুল হক। তখন আপিল বিভাগের সাত বিচারকের মধ্যে পাঁচজন মত দিয়েছিলেন যে, পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়া উচিত। কিন্তু সেই অংশ রায়ের মূল সিদ্ধান্ত থেকে বাদ দেন বিচারপতি খায়রুল। ফলে সরাসরি দলীয় সরকারের অধীনেই ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

বিতর্কিত রায় ও অপকর্মের তালিকা

সাবেক প্রধান বিচারপতি হিসেবে খায়রুল হকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো সর্বাধিক আলোচিত, সেগুলো হলো:

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল: নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংসের সূচনা হয় এই রায়ের মাধ্যমে।

খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ: ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের পেছনে ছিল খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের একতরফা রায়।

স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্কে রায়: ২০০৯ সালে রায়ে তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান নন, বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষক।

বিতর্কিত বিচারপতিদের শপথ: বিচারপতি খসরুজ্জামান ও হত্যা মামলার আসামি রুহুল কুদ্দুস বাবুকে হাইকোর্টে শপথ করান।

আগাম জামিনের এখতিয়ার বাতিল: হাইকোর্ট বিভাগের আগাম জামিন প্রদানের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় তার রায়ের মাধ্যমে।

ত্রাণ তহবিল আত্মসাত: প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে চিকিৎসা বাবদ ১০ লাখ টাকার বেশি গ্রহণ করেন, যা বিতর্কের জন্ম দেয়।

রাজউকের প্লট কেলেঙ্কারি: শর্ত না মানায় বাতিল হওয়া প্লট পরবর্তীতে অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় পুনরায় হস্তান্তর নেন।

চাকরি থেকে গাড়িচালককে জোরপূর্বক অবসর: ক্ষমতার অপব্যবহারে একজন চালককে অবসরে পাঠিয়ে দেন, যিনি বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

জাতীয়তাবাদী আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া

জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন,

“খায়রুল হক বিচার বিভাগে আয়নাঘর বানিয়ে গণতন্ত্র হত্যা করেছেন। তার বিচার শুধু আদালতে নয়, ইতিহাসের পাতায়ও হবে।”

ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন,

“তিনি ছিলেন শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্রের মূল আইনি প্রকৌশলী। বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।”

তদন্তে নতুন গতি, মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে দুদক

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানিয়েছে, সাবেক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। এর মধ্যে রাজউক প্লট, ত্রাণ তহবিলের অর্থ অপব্যবহার এবং আইন কমিশনের ক্ষমতার অপচয়ের মতো অভিযোগ রয়েছে।

দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পথে খায়রুল হকের গ্রেফতার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। একজন প্রধান বিচারপতির আসনে থেকে রাজনৈতিক পক্ষপাত ও বিচার ব্যবস্থার অপব্যবহারের যে নজির তিনি স্থাপন করেছেন, তার পরিণতি আজকের এই গ্রেফতার। জনগণ আশা করছে—এটি শুধু শুরু, আরও অনেকের মুখোশ একে একে খুলে আসবে।

আল-আমিন ইসলাম/

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ