ঢাকা, রবিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ১১ কার্তিক ১৪৩২

MD Zamirul Islam

Senior Reporter

শেয়ারবাজার ছাড়ছেন বিনিয়োগকারীরা: উঠে এলো ভয়াবহ তথ্য

শেয়ারনিউজ ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ অক্টোবর ২৬ ১৩:৫২:৪২
শেয়ারবাজার ছাড়ছেন বিনিয়োগকারীরা: উঠে এলো ভয়াবহ তথ্য

পুঁজিবাজার ছাড়ছেন বিনিয়োগকারীরা: ৫ মাসে ৪৭ হাজার হিসাব বন্ধ, সংস্কারে নেই অগ্রগতি

বিগত সরকারের আমলে মাফিয়া চক্রের অবৈধ অর্থ উপার্জনের কেন্দ্রে পরিণত হওয়া পুঁজিবাজার থেকে আবারও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। একটি বিশেষ গোষ্ঠীর অনিয়ম ও লুটপাটের কারণে হাজার কোটি টাকা হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। যদিও গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সূচক ও বাজার মূলধন অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়েছিল, কিন্তু সেই স্থিতিশীলতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। গত বছরের সেপ্টেম্বরে খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বে পূঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি দায়িত্ব নিয়ে সংস্কার কমিটি গঠনসহ একাধিক উদ্যোগ নিলেও এক বছরেও কোনো দৃশ্যমান ফল না আসায় বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা চরমে পৌঁছেছে।

রেকর্ড: ৫ মাসে বন্ধ ৪৭,৪০০-এর বেশি বিও অ্যাকাউন্ট

সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশের (সিডিবিএল) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে বিপুল সংখ্যক বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব বন্ধ হয়েছে। গত ২১ মে পুঁজিবাজারে মোট বিও হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ১৬ লাখ ৯০ হাজার ৫১১টি। সর্বশেষ গত ২২ অক্টোবর, বুধবার এই সংখ্যা নেমে আসে ১৬ লাখ ৪৩ হাজার ৩৫টিতে। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে মোট ৪৭ হাজার ৪৭৬টি হিসাব বন্ধ হয়ে গেছে।

তবে বর্তমানে চালু থাকা ১৬ লাখ ৪৩ হাজার বিও অ্যাকাউন্টের অধিকাংশই নিয়মিত লেনদেন করছে না। বুধবারের সর্বশেষ তথ্যমতে, ৬৬ হাজার ৫৯৩টি অ্যাকাউন্টে কখনোই ট্রেড বা লেনদেন হয়নি। অন্যদিকে, সব সিকিউরিটিজ বিক্রি করে বা সম্পূর্ণ অর্থ উত্তোলন করে হিসাব শূন্য করেছেন এমন বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৩৬৪টি। এক সপ্তাহ আগেও এই সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৭১টি; অর্থাৎ মাত্র এক সপ্তাহে ১ হাজার ২৯৩ জন বিনিয়োগকারী নতুন করে তাদের হিসাব শূন্য করেছেন।

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পলায়ন ও মূলধন হ্রাস

একই ৫ মাসের সময়কালে দেশের পুঁজিবাজার ছেড়েছেন প্রায় ৩ হাজার বিদেশি বিনিয়োগকারী। গত ২১ মে বিদেশি বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল ৪৬ হাজার ৩৩৭টি, যা সর্বশেষ বুধবার ৪৩ হাজার ৬১৫টিতে নেমে এসেছে। এতে এই সময়ে ২ হাজার ৭২২টি বিদেশি বিও হিসাবধারী বাজার ত্যাগ করেছেন।

এই সময়ে মার্কেট ক্যাপিটালও কমেছে প্রায় ২৭ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। সর্বশেষ গত সোমবার বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ৩ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা, অথচ এক মাস আগে সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে এটি সর্বোচ্চ ৭ লাখ ৩১ হাজার ৫৩ কোটি টাকা ছিল।

সংস্কারের উদ্যোগ ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন

খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর পুঁজিবাজার সংস্কারে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। শেয়ারবাজারে আমূল পরিবর্তন আনতে গত বছরের অক্টোবরে বিএসইসি ১৭টি সংস্কার সুপারিশ প্রণয়নের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। তাদের উদ্যোগগুলোর মধ্যে ছিল:

বিনিয়োগকারীদের জ্ঞান ও সচেতনতা বাড়াতে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আলোচনা ও বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতিবাচক বার্তা প্রচার ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সচেতন করা।

মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানি, রাষ্ট্রমালিকানাধীন লাভজনক প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আইপিওর মাধ্যমে তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ।

তালিকাভুক্ত না হওয়া কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তিতে উৎসাহিত করতে করছাড় এবং পুঁজিবাজারকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের প্রধান উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।

আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি, জাতীয় বাজেটে করছাড় সুবিধা ও লভ্যাংশ আয়ের ওপর করছাড় প্রদান।

কিন্তু এক বছর পার হলেও এই পদক্ষেপগুলোর দৃশ্যমান ফল না পাওয়ায় বিনিয়োগকারী ও বাজার সংশ্লিষ্টরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা জানান, রাশেদ মাকসুদ দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১ বছরে জরিমানা করা ছাড়া বাজারে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব ফেলতে পারেননি। এই সময়ে দেড় হাজার কোটি টাকা জরিমানা করা হলেও তার এক টাকাও আদায় হয়নি। উল্টো ক্রমাগত দর পতনে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি ২০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।

কারসাজি চক্রের তৎপরতা ও কমিটির ব্যর্থতা

এই পরিস্থিতিতেও ২৫-৩০টি শেয়ার নিয়ে কারসাজির ঘটনা ঘটেছে, যা কমিশন ঠেকাতে পারেনি। সম্প্রতি শ্যামপুর সুগার, মাগুরা কমপ্লেক্স, মনোস্পুল বাংলাদেশ, মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজসহ কয়েকটি কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি হয়। অথচ এই সময়ে কোনো নতুন প্রতিষ্ঠান বাজারে তালিকাভুক্ত হয়নি। ফলে কমিটিগুলোর কাজ বৈঠকসর্বস্ব হওয়ায় বাস্তব ফলাফল শূন্য।

শীর্ষ মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা হতাশ হয়ে বলেন, কমিশন কী সংস্কার করছে, তা তারা জানেন না। তাদের মতে, বিএসইসি গঠিত সংস্কার টাস্কফোর্স কেবল আইপিও, মিউচুয়াল ফান্ড এবং মার্জিন ঋণ বিধিমালার সংশোধনে বেশি মনোযোগী। তারা বিগত কমিশনের দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণ, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ভবিষ্যতে তা রোধের উপায় নিয়ে সংস্কার কমিটির কোনো পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছেন না।

প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশও উপেক্ষিত

শেয়ারবাজারে ক্রমাগত দরপতন নিয়ে জনমনে ক্ষোভ বাড়লে গত ১১ মে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তিন মাসের মধ্যে সংস্কার সুপারিশ প্রণয়নে বিদেশি পরামর্শক নিয়োগের নির্দেশ দেন। কিন্তু তিন মাস পেরিয়ে গেলেও সেই পরামর্শক নিয়োগের কোনো খবর নেই। বিএসইসির এক কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে জানান, সর্বশেষ জুনে এ বিষয়ে ফাইলে 'টার্মস অব কন্ডিশন'-এর উল্লেখ ছিল, তবে পরবর্তী অগ্রগতি অজ্ঞাত।

প্রধান উপদেষ্টা দেশীয়, রাষ্ট্রীয় ও বহুজাতিক বড় কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করারও নির্দেশনা দেন। এ নিয়ে বিএসইসি বৈঠক করলেও ফল শূন্য। পাশাপাশি বিগত সময়ের অনিয়ম ও দুর্নীতি অনুসন্ধান করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছিল।

জরিমানা বেড়েছে, আদায় শূন্য

দায়িত্ব গ্রহণের পর গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ১ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা জরিমানা করে বিএসইসি। তবে এই বিপুল জরিমানার বিপরীতে আদায় প্রায় শূন্য। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা এই ধরনের জরিমানা আরোপকে বাজারের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করছেন।

ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মো. মহসীন বলেন, এখন জরিমানা করা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, বিশেষ করে যখন আদায় হচ্ছে না। তিনি ডিএসইর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রহমান চৌধুরী কারসাজির জন্য অডিট ফার্ম, ইস্যু ম্যানেজার এবং স্টক মার্কেট ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তাদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনার দাবি জানান।

বাজার বিশ্লেষকের দৃষ্টিতে আর্থিক জ্ঞানের ঘাটতি

বাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. আল-আমিন বলেন, আমাদের পুঁজিবাজার গুজবনির্ভর। বিনিয়োগে প্রয়োজনীয় প্যারামিটার (এনএভি, ইপিএস ইত্যাদি) দেখা হয় না, ফলে জরিমানা করা যৌক্তিক। তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ হলো নিয়ম-শৃঙ্খলা দেখাশোনা করা। যারা বলছে জরিমানার কারণে মার্কেট নষ্ট হচ্ছে, তারা একটি বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে, যারা কারসাজি চক্রকে 'ব্ল্যাঙ্ক চেক' দিতে চায়।

বিএসইসি মুখপাত্র আবুল কালামের ব্যাখ্যা: নতুন কমিশন ১২টি অনুসন্ধান রিপোর্টের মধ্যে ৭টির ওপর ব্যবস্থা নিয়েছে। মিউচুয়াল ফান্ড, পাবলিক ইস্যু রুলস ও মার্জিন রুলসের মতো ৩টি প্রধান টাস্কফোর্সের কাজ শেষের পথে। প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশিত রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি তালিকাভুক্তির কাজও চলছে। বন্ড মার্কেট উন্নয়নের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে ব্যাংক নির্ভরতা কমানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের যৌথ কমিটি কাজ করছে। তিনি বলেন, কমিশনের নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপ এখন শেষের দিকে। নতুন কোম্পানি আইপিওতে না আসার কারণ হিসেবে তিনি পূর্বের কমিশনের শিথিলতা এবং বর্তমান কমিশনের কঠোর পরিপালনকে ইঙ্গিত করেন।

আল-মামুন/

পাঠকের মতামত:

ট্যাগ: ডিএসই বিএসইসি খন্দকার রাশেদ মাকসুদ শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা পুঁজিবাজার ছাড়ছেন বিনিয়োগকারীরা বিও হিসাব বন্ধ বাজার মূলধন হ্রাস বিএসইসি সংস্কার ব্যর্থ বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রত্যাহার পুঁজিবাজারে আস্থাহীনতা ৫ মাসে ৪৭ হাজার বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধ রাশেদ মাকসুদ কমিশন পুঁজিবাজার সংস্কারের উদ্যোগ বিদেশি বিনিয়োগকারী কেন বাজার ছাড়ছে পুঁজিবাজার কারসাজি শেয়ারবাজারে দরপতন জরিমানা আদায় হয়নি বিনিয়োগকারীদের পুঁজিহানি বিএসইসি টাস্কফোর্স পুঁজিবাজারে নতুন অস্থিরতা প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা জেড ক্যাটাগরি ও ওটিসি সমস্যা মো. মহসীন মিজানুর রহমান চৌধুরী সিডিবিএল তথ্য ড. আল-আমিন আবুল কালাম

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ