ঢাকা, শনিবার, ৩১ মে ২০২৫, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

‘হাসনাত ও সারজিসকে হত্যা’র ভয়াবহ ছক

রাজনীতি ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ মে ৩০ ১৬:১৭:০৪
‘হাসনাত ও সারজিসকে হত্যা’র ভয়াবহ ছক

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাতের নিঃশব্দতা ভেদ করে দেশের মাটিতে পা রাখে এক ভূতের মতো মানুষ—নাম তার সুব্রত বাইন। কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়, কোনো বিচারিক প্রক্রিয়া নয়, বরং যেন রুদ্ধদ্বার এক রাষ্ট্রীয় থ্রিলারের চরিত্র হয়ে ফিরে আসেন তিনি। কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেল থেকে বাংলাদেশের সিলেট সীমান্ত পেরিয়ে ফেরা তার এই ‘ফিরে আসা’ আদতে এক নতুন নাটকের শুরু।

যার কাহিনি কেবল অস্ত্র, রক্ত ও ষড়যন্ত্রে গড়া নয়; বরং তাতে মিশে আছে রাজনীতি, গোয়েন্দা অপারেশন, আন্তর্জাতিক সখ্যতা, এবং বিশ্বাসঘাতকতার কুণ্ডলী পাকানো জাল।

ফেরার নেপথ্যে ‘প্রজেক্ট এক্স’

২০২২ সালের এক শীতার্ত রাতে সিলেট সীমান্তের এক ফাঁকা এলাকায় চুপচাপ ঢুকে পড়ে এক মানুষ, যার নাম তখনো অনেকের স্মৃতিতে একটি আতঙ্ক। তাকে নিয়ে কোনো সংবাদ নেই, মিডিয়ায় খবর—সে নাকি মৃত। অথচ জীবিত থেকে চলছিল তার নতুন রূপে জন্ম—এক ভয়ংকর মিশনের যোদ্ধা হিসেবে।

সূত্র বলছে, এই গোপন অভিযানের নাম ছিল ‘প্রজেক্ট এক্স’। এই মিশনের ছায়া পড়েছে দেশের রাজনীতির সর্বোচ্চ স্তরে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন, এনটিএমসির প্রাক্তন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল হাসানের সরাসরি তত্ত্বাবধান—সব মিলিয়ে এটি ছিল এক স্পর্শকাতর, অস্বীকারযোগ্য কিন্তু বাস্তব রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা।

টার্গেট: তারেক রহমান ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ

এই মিশনের মূল লক্ষ্য ছিল যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। পরিকল্পনা ছিল নির্মম—জুমার নামাজের সময় স্নাইপার দিয়ে গুলি করে হত্যা। যাতে সন্দেহ না পড়ে, তাই সুব্রতকে দেওয়া হয় পাকিস্তানি পাসপোর্ট। তাকে শেখানো হয় নিখুঁত নিশানায় গুলি চালানো, রাইফেলের আচরণ বোঝা, স্নাইপারের মতো নিঃশব্দে মিশে যাওয়া শহরের ভিড়ে।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এই ‘টার্গেট কিলিং’ অপারেশনের তালিকায় ছিল আরও অনেক নাম—বিএনপি, জামায়াত এবং নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা। হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম—তাঁরাও ছিলেন সেই তালিকায়, যাদের মৃত্যু দিয়ে নাকি তৈরি হতো রাজনৈতিক অস্থিরতা, যাতে করে ক্ষমতা ধরে রাখা যায় সহজেই।

অস্ত্রের স্রোত, রাজধানীর গলিতে গলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সন্ত্রাস

সুব্রতের দেওয়া তথ্যে উঠে আসে, সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র ঢুকত দেশেই। তারপর রাজধানীর মগবাজার, গুলশান, শাহবাগ, বাড্ডা—এসব অঞ্চলে তা পৌঁছাতো নির্দিষ্ট সন্ত্রাসী চক্রের হাতে। তারা সেই অস্ত্র ব্যবহার করে চালাতো নিখুঁত অপারেশন। রাষ্ট্রের ছায়ায় জন্ম নেওয়া এই চক্রগুলোকে খুঁজে বের করাই এখন তদন্তের প্রধান চ্যালেঞ্জ।

পরিকল্পনার কারিগররা কে কে?

জবানবন্দিতে উঠে এসেছে কিছু প্রভাবশালী নাম। ২০২৩ সালে একাধিকবার দেখা হয় সুব্রতের সঙ্গে—সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, এনটিএমসির তৎকালীন ডিজি জিয়াউল হাসান এবং পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম। এমনকি লন্ডনে মিশনের সহায়তায় যুক্ত ছিলেন বলে এসেছে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিমের নামও।

এই সমস্ত নাম এখন নীরব—তবে সুব্রতের জবানিতে যেন উচ্চারিত হচ্ছে তাদের নিরব সম্মতি।

এক ‘মৃত’ সন্তানের গল্পে মৃত্যু হয়েছিল মায়েরও

২০২২ সালে সংবাদমাধ্যমে গুজব রটে, সুব্রত বাইন নাকি নিহত। সেই গুজবে বিশ্বাস করে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তার মা, কমলিনী বাইন। আর সেই সময়েই বাস্তবে সুব্রত অস্ত্র হাতে নিচ্ছিল, প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল আরেক জীবনের জন্য, আরেক লক্ষ্য পূরণের জন্য।

এক গোপন যুদ্ধের পর্দা উঠছে?

২০২৫ সালের মে মাসে কুষ্টিয়ার এক বাড়িতে অভিযান চালিয়ে যৌথ বাহিনী গ্রেপ্তার করে সুব্রত বাইন ও তার এক সহযোগীকে। বর্তমানে সে ৮ দিনের রিমান্ডে। প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টা তার কাছ থেকে বেরিয়ে আসছে নতুন বিস্ফোরক তথ্য। যেগুলোর সত্যতা নিশ্চিত হলে এ শুধু আরেকটি সন্ত্রাস

এই কাহিনি কি কেবল সুব্রতের? নাকি এর গভীরে লুকিয়ে আছে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের এক গোপন মুখ? সত্য প্রকাশ পাবে কি, নাকি আরও একবার ধুলোর নিচে চাপা পড়ে যাবে ইতিহাস?

উত্তর সময় দেবে, কিন্তু এখন যা পরিষ্কার—বাংলাদেশের রাজনীতির মঞ্চে এক অদৃশ্য যুদ্ধ অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে। এখন সেই যুদ্ধের অস্ত্র হচ্ছে সত্য, আর সময়ই দেখাবে কে বাঁচে, কে হারে।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ