ঢাকা, শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২

চার লাখ কোটির খেলাপি: ১০ ব্যাংকেই আটকে তিন লাখ কোটি

অর্থনীতি ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ জুন ১৯ ১১:০৬:৩০
চার লাখ কোটির খেলাপি: ১০ ব্যাংকেই আটকে তিন লাখ কোটি

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত যেন এক গভীর খাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি এই খাতটি আজ দুর্নীতি, প্রভাবশালীদের লুণ্ঠন আর রাজনৈতিক অনিয়মে বিপর্যস্ত। মার্চ পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে চার লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকায়—যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে মাত্র ১০টি ব্যাংকে আটকে আছে তিন লাখ ২৮ কোটি টাকারও বেশি। হিসাব বলছে, খেলাপির ৭১ শতাংশই এই ১০ ব্যাংকের ঘাড়ে।

এই ব্যাংকগুলোর তালিকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক যেমন আছে, তেমনি আছে বেসরকারি ব্যাংকও। কিন্তু মিল একটাই—সবগুলোই লুটপাট ও কেলেঙ্কারির কেন্দ্রস্থল। মূল ভূমিকা রেখেছে কিছু প্রভাবশালী গ্রুপ, রাজনৈতিক দাপটে যাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখা হয়েছিল বছরের পর বছর।

‌জনতা ব্যাংক: জনপ্রিয়তা হারিয়ে জনতার আতঙ্কে রূপান্তর

এক সময়ের গর্বের নাম ছিল জনতা ব্যাংক। অথচ এখন এটি দেশের সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত ব্যাংক। ব্যাংকটি ৯৪ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল, যার মধ্যে ৭০ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে! ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। বেক্সিমকো, থার্মেক্স, অ্যানটেক্স, ক্রিসেন্ট, এমনকি এস আলম গ্রুপ—সবাই ছিল এই ব্যাংকের প্রিয় অতিথি। অথচ ঋণ শোধ? সেটি যেন ‘মুছে যাক গানের মতো’।

ইসলামী ব্যাংক: শরিয়াহ ভিত্তিক ব্যাংক থেকে শরিয়াহ ভঙ্গের উপাখ্যান

দেশের সবচেয়ে বড় শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকও আজ দেউলিয়ার মুখে। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ৭ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ৬১৮ কোটি টাকায়। দায় কার? উত্তরটা সহজ—এস আলম গ্রুপ। এই গ্রুপ শুধু ঋণ নেয়নি, ব্যাংকের পরিচালনাও নিয়ন্ত্রণ করেছে দীর্ঘদিন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের অর্ধেকের বেশি গেছে এস আলম ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানে। অর্থাৎ নিজের ব্যাংক থেকে নিজের পকেটে অর্থ।

অগ্রণী, সোনালী ও রূপালী: রাষ্ট্রের নামে বেসাতি

রাষ্ট্রের নামে পরিচালিত হলেও, এই তিন ব্যাংক যেন হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক স্বার্থ বাস্তবায়নের ‘মাধ্যম’।

অগ্রণী ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ২৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ৪১.৩৫%।

সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ১৯ হাজার ৯১ কোটি টাকা।

রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ১৭ হাজার ১২২ কোটি টাকা।

অগ্রণীর চেয়ারম্যান খোলামেলা স্বীকার করেছেন, “আমরা বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে চেয়েছি, তাই খেলাপির পরিমাণ বেড়েছে।”

ন্যাশনাল ব্যাংক: প্রথম বেসরকারি ব্যাংকের পতনের গল্প

দেশের প্রথম বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল ব্যাংক এক সময় আস্থার প্রতীক ছিল। এখন এটি খেলাপি ঋণের দিক দিয়ে দ্বিতীয় সারির ‘হেভিওয়েট’। মার্চে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ২৭ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা—যা ব্যাংকের মোট ঋণের ৬৪ শতাংশ! এক সময় সিকদার গ্রুপের আধিপত্যে চলা এই ব্যাংক এখন রাজনৈতিক পালাবদলের পর নতুন পরিচালনায় গেলেও আর্থিক ক্ষত পূরণ হয়নি।

এস আলমের ছায়ায় তিন ব্যাংক

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক—এই তিনটি ব্যাংকই এস আলম গ্রুপের ছায়া থেকে বের হতে পারেনি। তিনটির খেলাপি ঋণ মিলে দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকার বেশি।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক: ২২ হাজার ৬৪৬ কোটি (৩৬.৬৩%)

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক: ১৪ হাজার ৩৬০ কোটি (৩৮%)

ইউনিয়ন ব্যাংক: ২৫ হাজার ৩০৩ কোটি (প্রায় ৯০%)

আইএফআইসি: প্রভাবশালীদের 'পারসোনাল ব্যাংক'?

মাত্র ৯ মাসে আইএফআইসি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা থেকে লাফিয়ে দাঁড়ায় ২৫ হাজার ৯৭১ কোটি টাকায়। ব্যাংকটির কর্মকর্তারা সাবেক চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের ‘ব্যক্তিগত ব্যবহার’ কে দায়ী করছেন, যিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ ও মামলা-পাল্টা মামলা

বাংলাদেশ ব্যাংক অন্তর্বর্তী সরকারের পর অন্তত ১০টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে। ইসলামী ব্যাংক জানায়, গত দুই মাসে এস আলমসহ বড় খেলাপিদের বিরুদ্ধে ৩৭০টি মামলা করা হয়েছে।

তবে প্রশ্ন থেকে যায়—ব্যাংক লুট হয়ে যাওয়ার পর মামলা করে কতটুকু ফেরত আসবে?

বিশেষ ট্রাইব্যুনালের আহ্বান

অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম সাফ জানিয়ে দিয়েছেন—“ঋণখেলাপিদের বিচারের আওতায় আনতে হলে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ছাড়া উপায় নেই। নয়তো, আজকের খেলাপিরা আগামী দিনের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠবে।”

ব্যাংক নয়, যেন রাজনীতির ‘ব্যক্তিগত এ.টি.এম.’

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন যেন কিছু গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত এ.টি.এম. মেশিনে পরিণত হয়েছে। যেখানে আমানতদার সাধারণ মানুষের টাকা লুটপাট হচ্ছে দিনের আলোয়। হিসাব বলছে, ‘খেলাপি’ এখন আর আর্থিক পরিভাষা নয়—এটি একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি। আর যতদিন এই সংস্কৃতি বদলাবে না, ততদিন এই চার লাখ কোটির খেলাপি শুধু সংখ্যা বাড়াবে—সমাধান নয়।

মো: রাজিব আলী/

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ