ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আর্থিক খাতে স্বস্তির ইঙ্গিত: খেলাপি ঋণ কমেছে হাজার কোটি

অর্থনীতি ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ মে ২৬ ২২:৫৫:৪২
আর্থিক খাতে স্বস্তির ইঙ্গিত: খেলাপি ঋণ কমেছে হাজার কোটি

নিজস্ব প্রতিবেদক: যেখানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পাহাড় দিনে দিনে আরও ভারী হচ্ছে, সেখানে ভিন্ন এক পথে হেঁটেছে দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) খাত। ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে এই খাতে দেখা মিলেছে এক বিরল স্বস্তির—খেলাপি ঋণ কমেছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে এমন ইতিবাচক প্রবণতা যেন সাহস যোগাচ্ছে পুনরুদ্ধারের আশায় থাকা আর্থিক খাতকে।

বিপরীতধর্মী বাস্তবতা

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর শেষে এনবিএফআই খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৬ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে, অর্থাৎ ডিসেম্বর শেষে তা নেমে এসেছে ২৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকায়। এক হাজার কোটির কাছাকাছি এই পতন কেবল পরিসংখ্যান নয়—এটা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে দীর্ঘদিনের স্থবিরতা কাটিয়ে খাতটি নতুন করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পথে এগোচ্ছে।

তবে পরিসংখ্যানের আরেকটি দিকও চোখে পড়ার মতো। বর্তমানে এনবিএফআই খাতে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৩৩.২৫ শতাংশে, অর্থাৎ প্রতি ৩ টাকার ১ টাকাই ফেরত আসার ঝুঁকিতে। এটাই বলে দেয়, সাময়িক উন্নতি হলেও পথ এখনও দীর্ঘ ও চ্যালেঞ্জে ভরা।

“সব প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ নয়”—আশাবাদী বাংলাদেশ ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল নয়। অনেক প্রতিষ্ঠান ভালো করছে এবং তাদের ঋণ আদায়ের হারও বাড়ছে।” একইসঙ্গে তিনি সতর্ক করে দেন, “তবুও এক-তৃতীয়াংশের বেশি ঋণ খেলাপি হওয়া এই খাতের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।”

ব্যতিক্রম কেন ঘটল?

বিশেষজ্ঞ ও খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, ডিসেম্বর মাসে ‘ব্যালান্স শিট’-এর চাপ থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ আদায় ও পুনঃতফসিলে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায়। তাছাড়া কিছু প্রতিষ্ঠান অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় সংস্কার এনে পেশাদারিত্বে জোর দিয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে আদায়ের হার বেড়েছে, এবং খেলাপির পরিমাণ কমেছে। একে বলা যায় ব্যবস্থাপনার সাফল্য ও চাপের যৌথ প্রভাব।

তবে বছরজুড়ে বেড়েছে ঋণ খেলাপি

যদিও শেষ প্রান্তিকে কমেছে খেলাপি ঋণ, পুরো বছর মিলিয়ে চিত্রটা ততটা আশাব্যঞ্জক নয়। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে এনবিএফআই খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২১ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের একই সময় তা দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৮৯ কোটিতে—অর্থাৎ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সাম্প্রতিক স্বস্তি সত্ত্বেও দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতা এখনও ঊর্ধ্বমুখী।

ব্যাংক খাত: ছায়াঘেরা বাস্তবতা

এদিকে দেশের ব্যাংক খাত যেন খেলাপির অন্ধকারে আরও একধাপ ডুবে গেছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২০.২ শতাংশ। অথচ মাত্র তিন মাস আগেই এই পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা—অর্থাৎ বেড়েছে ৬০ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। এই বৃদ্ধির হার আতঙ্কের সীমা ছাড়িয়ে গেছে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

পুরনো কেলেঙ্কারির ছায়া কাটেনি

পি কে হালদারের মতো কেলেঙ্কারির গভীর ক্ষত এখনও কিছু এনবিএফআই প্রতিষ্ঠানকে রক্তাক্ত করে রেখেছে। যেসব প্রতিষ্ঠান তার নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেগুলোতেই খেলাপির হার সবচেয়ে বেশি। ফলে কিছু প্রতিষ্ঠান যতই ঘুরে দাঁড়াক, সামগ্রিকভাবে ঝুঁকি কাটেনি বলেই মনে করছেন আর্থিক বিশ্লেষকরা।

কী হবে এখন?

এই প্রবণতা ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন হবে কঠোর তদারকি, স্বচ্ছতা ও পেশাদার নেতৃত্ব। বিশেষ করে ঋণ প্রদানের আগে যথাযথ যাচাই, আদায় প্রক্রিয়ায় জবাবদিহিতা এবং খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে কঠোরতা—এসব না থাকলে এই ক্ষণস্থায়ী স্বস্তি হারিয়ে যেতে পারে অতীতের চেনা সংকটে।

যেখানে একপাশে আর্থিক ব্যবস্থার আস্থা হারাতে বসেছে ব্যাংক খাত, সেখানে এনবিএফআই-এর এই ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলছে—পরিবর্তন সম্ভব, যদি থাকে সদিচ্ছা ও সঠিক দিকনির্দেশনা।

এই ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পটা যেন স্থায়ী হয়, সেটাই এখন সময়ের দাবি।

FAQ (প্রশ্ন ও উত্তর):

প্রশ্ন ১: এনবিএফআই খাতে খেলাপি ঋণ কেন কমেছে?

উত্তর: বছরের শেষ প্রান্তিকে ঋণ আদায় বাড়ানো ও অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় সংস্কারের কারণে এনবিএফআই খাতে খেলাপি ঋণ কমেছে।

প্রশ্ন ২: ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কেন বেড়েছে?

উত্তর: ব্যাংকগুলোতে ঋণ আদায় কমজোরি ও উচ্চ ঝুঁকির ঋণ বৃদ্ধির কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রশ্ন ৩: খেলাপি ঋণের বর্তমান হার কত?

উত্তর: এনবিএফআই খাতে খেলাপি ঋণের হার মোট ঋণের ৩৩.২৫ শতাংশ এবং ব্যাংক খাতে ২০.২ শতাংশ।

প্রশ্ন ৪: খেলাপি ঋণ কমাতে কি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?

উত্তর: আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ আদায়ের জন্য ব্যবস্থাপনায় সংস্কার করছে এবং বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মিত তদারকি বৃদ্ধি করছে।

জামিরুল ইসলাম/

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ