ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১ আশ্বিন ১৪৩২

Alamin Islam

Senior Reporter

শেয়ারবাজারে ভয়ংকর প্রতারণা: অন্ধকারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ঝুঁকিতে বিনিয়োগকারীরা

শেয়ারনিউজ ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ সেপ্টেম্বর ২৬ ১০:৩৩:৩২
শেয়ারবাজারে ভয়ংকর প্রতারণা: অন্ধকারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ঝুঁকিতে বিনিয়োগকারীরা

দেশের পুঁজিবাজারে সম্প্রতি একটি সুচতুর কৌশলে তালিকাভুক্ত কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। মাত্র দুই সপ্তাহ থেকে দুই মাসের মধ্যে কিছু শেয়ারের দর দ্বিগুণ হওয়ার ঘটনা ঘটছে, যা কৃত্রিমভাবে মূল্যস্ফীতির ইঙ্গিত বহন করে।

এই প্রক্রিয়ায় এক শ্রেণির অসাধু চক্র রাতারাতি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, অথচ কোটি কোটি টাকার লোকসানের বোঝা চাপছে সাধারণ, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কাঁধে। অভিযোগের তীর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং দেশের স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর দুর্বল নজরদারির দিকে।

গোপন তথ্য আর কারসাজির চতুর খেলা

সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, পুঁজিবাজারে এমন অনেক কোম্পানি সক্রিয় রয়েছে, যারা বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিয়মিত প্রতারণা চালাচ্ছে। মূল্য সংবেদনশীল তথ্য গোপন করে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দর বাড়িয়ে বিশেষ সুবিধা নিচ্ছে কোম্পানি-সংশ্লিষ্ট ও তাদের পছন্দের একটি চক্র। এমনকি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকেরাও এই কারসাজিতে যুক্ত হয়ে অধিক মূল্যে নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে মোটা অঙ্কের অর্থ কামিয়ে নিচ্ছেন। অথচ, এই ধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ডের জন্য তাদের কোনো শাস্তির মুখোমুখি হতে হচ্ছে না।`বাজার-বিশ্লেষকরাও এই অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেছেন। তাদের মতে, কিছু কোম্পানি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই কাজগুলো করছে। কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো সাধারণ ঘোষণার অনেক আগেই একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির বিনিয়োগকারীদের জানিয়ে দেওয়া হয়। এই চক্রটি প্রথমে কম দামে শেয়ার কিনে নেয় এবং পরে কিছু ব্রোকারেজ হাউজের মাধ্যমে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ভুয়া বার্তা ছড়িয়ে দেয়। এর ফলে শেয়ারটির দর দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে।

কিন্তু এই অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি দীর্ঘস্থায়ী হয় না এবং এক পর্যায়ে তা ধসে পড়ে, যার ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ বিপুল পরিমাণ লোকসানের শিকার হয়। অনেক সময় কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরাও নিজেদের মালিকানার অংশবিশেষ বিক্রি করে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন।

প্রতারণার কিছু উদ্বেগজনক দৃষ্টান্ত:

কে অ্যান্ড কিউ (বাংলাদেশ) লিমিটেড: প্রকৌশল খাতের এই কোম্পানিটির শেয়ারের দর মাত্র দুই মাসেরও কম সময়ে ৯৩ শতাংশ বা প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ৮ জুলাই ১৯৯ টাকায় লেনদেন হওয়া শেয়ারটি ১ সেপ্টেম্বরে ৩৮২ টাকা ৭০ পয়সায় গিয়ে দাঁড়ায়।

এই অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি সম্পর্কে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) থেকে দুবার জানতে চাওয়া হলে কোম্পানিটি জানায়, তাদের কাছে এর কোনো কারণ জানা নেই। অথচ, দুই মাস শেষ না হতেই কোম্পানিটি ঘোষণা করে যে, তারা খুচরা পর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) সরবরাহ করবে এবং এজন্য একটি নতুন ইউনিট চালু করেছে, যা তাদের মুনাফা বাড়াতে সহায়ক হবে।

সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস লিমিটেড: গত ২৯ জুলাইয়ের পর থেকে এই কোম্পানিটির শেয়ারের দর ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় রয়েছে। ওইদিন ১৫২ টাকা ১০ পয়সায় লেনদেন হওয়া শেয়ারটি ৪ সেপ্টেম্বর লেনদেন শেষে ২৯৯ টাকা ৮০ পয়সায় উন্নীত হয়। অর্থাৎ, মাত্র এক মাসের ব্যবধানে শেয়ারটির দর ১৪৭ টাকা ৭০ পয়সা বা ৯৭ শতাংশ বেড়েছে। কোম্পানিটির কাছে অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়ে ডিএসই চিঠি দিলে তারাও 'কারণ অজানা' বলে জবাব দেয়। কিন্তু, টানা এক মাস দরবৃদ্ধির পর কোম্পানিটির পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, তারা তৃতীয় উৎপাদন ইউনিট চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এজন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা হবে।

মাগুরা কমপ্লেক্স পিএলসি ও মনোস্পুল বাংলাদেশ পিএলসি: মাত্র ১৭ কার্যদিবসে মাগুরা কমপ্লেক্স পিএলসি-এর শেয়ারের দর ২৬ টাকা ৮০ পয়সা বা প্রায় ৩১ শতাংশ বেড়েছে। ২৯ জুলাই ৮৭ টাকা ২০ পয়সায় লেনদেন হওয়া শেয়ারটি ২৪ আগস্ট ১১৪ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। একই গ্রুপের আরেক কোম্পানি মনোস্পুল বাংলাদেশ পিএলসি-এর শেয়ারের দরও ২৯ জুলাইয়ের পর থেকে ঊর্ধ্বমুখী ছিল। ওইদিন ৯৯ টাকা ৪০ পয়সায় লেনদেন হওয়া শেয়ারটি ২৪ আগস্ট ১২৪ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়, অর্থাৎ আলোচিত ১৭ কার্যদিবসের ব্যবধানে এর দর ২৪ টাকা ৬০ পয়সা বা প্রায় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। দুটি কোম্পানিই ডিএসই-এর চিঠির জবাবে 'অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির কারণ অজানা' বলে জানায়। অথচ, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে তারা পুনরায় জানায়, তারা উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে নতুন মেশিনারিজ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড: সম্প্রতি মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর শেয়ারের দরও

অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে দেখা গেছে। মাত্র ১৩ কার্যদিবসের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ারের দর ৮ টাকা ৭০ পয়সা বা ৩২ শতাংশের বেশি বেড়েছে। গত ২৪ আগস্ট ২৭ টাকার শেয়ারটি ১০ সেপ্টেম্বর লেনদেন শেষে ৩৫ টাকা ৭০ পয়সায় উঠে যায়। ৭ সেপ্টেম্বর ডিএসই থেকে এই দরবৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে কোম্পানিটি একইভাবে 'অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির কারণ তাদের জানা নেই' বলে জানায়।`তবে, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) সূত্রে জানা গেছে, মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে তারা তাদের চাহিদার অর্ধেক (৫০ শতাংশ) ব্যাগ ক্রয় করবে। সরকারি এই প্রতিষ্ঠান বিপুল পরিমাণ ব্যাগ ক্রয় করলে মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজের মুনাফায় বড় পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি চিঠিও গত ১ সেপ্টেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে ইস্যু হয়েছে। অথচ তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি বলছে, তারা এ বিষয়ে কিছুই জানে না। ১৬ সেপ্টেম্বর মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজের কোম্পানি সচিব মো. ওমর ফারুক জানান, তাদের কাছে এমন কোনো তথ্য নেই এবং চিঠি পেলে নিয়ম অনুযায়ী স্টক এক্সচেঞ্জকে জানানো হবে।

বিশ্লেষক ও বাজার-সংশ্লিষ্টদের অভিযোগের তীর

কোম্পানিগুলোর এমন 'চতুরতা' সঠিকভাবে শনাক্ত করতে না পারার জন্য স্টক এক্সচেঞ্জ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকেই দায়ী করছেন বিশ্লেষক ও বাজার-সংশ্লিষ্টরা। তারা এই দুই রেগুলেটরি বডিকে আরও বেশি সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন মন্তব্য করেন, "কোম্পানির কাছে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (পিএসআই) থাকা সত্ত্বেও যদি তারা গোপন করে, তাহলে সেটি সরাসরি প্রতারণা। আমাদের দেশে কোম্পানির জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার বিষয়টি তুলনামূলকভাবে কম।" তিনি মনে করেন, যখন কোম্পানিগুলোকে যথাযথ গাইডলাইনের আওতায় এনে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, তখন এই ধরনের কারসাজি বন্ধ হবে। তিনি আরও যোগ করেন, "স্টক এক্সচেঞ্জ কিংবা নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে যদি শুধুমাত্র রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে দায়সারাভাবে কারণ জানতে চাওয়া হয়, তাহলে বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু অ্যাকশনও নিতে হবে।"

তবে, ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম মনে করেন, এক্ষেত্রে 'স্টক এক্সচেঞ্জের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে'। তিনি বলেন, "এটি সরাসরি কোম্পানির প্রতারণা না হলেও দুর্বলতার প্রকাশ। কোম্পানিগুলোকে তাদের দায়িত্বের ব্যাপারে আরও সচেতন হতে হবে। স্টক এক্সচেঞ্জকেও আরও সক্ষমতা বাড়িয়ে তাৎক্ষণিক এই বিষয়গুলো চিহ্নিত করে পদক্ষেপ নিতে হবে।"

নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর বক্তব্য:

সক্ষমতায় ঘাটতি থাকার বিষয়টি ডিএসই-সংশ্লিষ্টরাও স্বীকার করেছেন। স্টক এক্সচেঞ্জটির শেয়ারধারী পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, "কিছু কোম্পানি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সঠিক তথ্য সঠিক সময়ে ডিএসই-এর কাছে উপস্থাপন করছে না। যদিও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা এই মুহূর্তে তাদের কাছে নেই। তবে ডিএসই এই বিষয়গুলো তাৎক্ষণিকভাবে চিহ্নিত করে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে জানাতে পারে।"

ডিএসই-এর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, "কোম্পানির ক্ষেত্রে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের একটি নির্দিষ্ট সময় আছে। তার আগে কোম্পানিগুলো সেটি প্রকাশ করতে পারে না। কেউ যদি অগ্রিম তথ্য দিয়ে ‘ইনসাইডার ট্রেডিং’ করে থাকে সেটি আমরা জবাবদিহিতার আওতায় আনছি। আমরা এরই মধ্যে আমাদের সার্ভিলেন্স বিভাগের সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে কাজ শুরু করেছি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি-এর কাছেও আমরা তাদের সার্ভিলেন্স মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার করার জন্য চিঠি দিয়েছি। কোনো কোম্পানি ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"

সার্বিক বিষয়ে বিএসইসি-এর পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম বলেন, "বিষয়টি আমাদের সার্ভিলেন্স বিভাগ দেখাশোনা করে। এক্ষেত্রে ইনসাইডার ট্রেডিং হয়েছে কি না, সেটি খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (সুবিধাভোগী ব্যবসা নিষিদ্ধকরণ) বিধিমালা, ২০২২ অনুযায়ী, ইনসাইডার ট্রেডিং অর্থাৎ সুবিধাভোগী ব্যবসা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এটি প্রমাণিত হলে কমিশন ১৯৬৯ অর্ডিন্যান্স-এর ক্ষমতাবলে সর্বনিম্ন এক লাখ টাকা থেকে অপরাধের পরিমাণ অনুযায়ী কোটি কোটি টাকা জরিমানা করতে পারে।"

পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর আরও কঠোর পদক্ষেপ ও ত্বরিত কার্যকারিতা এখন সময়ের দাবি।

আল-মামুন/

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ