ঢাকা, রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২ আশ্বিন ১৪৩২

MD Zamirul Islam

Senior Reporter

ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানির একীভূতকরণ: বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকটে

শেয়ারনিউজ ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ সেপ্টেম্বর ২৮ ০০:১৪:৫৭
ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানির একীভূতকরণ: বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকটে

দেশের আর্থিক খাতে চলমান অস্থিরতার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক সাহসী পদক্ষেপগুলো যেমন শরিয়াহ-ভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করা এবং নয়টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) অবসায়নের সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে ঋণখেলাপি সমস্যা মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ। তবে, এই সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাব হাজার হাজার সাধারণ বিনিয়োগকারীর ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। এর ফলস্বরূপ, শেয়ারবাজারে এক গভীর আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত।

বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ: তথ্যের অভাবে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা

আলোচিত ১৪টি প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত, যার অর্থ এগুলোর সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত অসংখ্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। আশ্চর্যজনকভাবে, বাংলাদেশ ব্যাংক এমন বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-এর সাথে কোনো রকম পরামর্শ করেনি। এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কর্তৃক গঠিত ব্যাংক একীভূতকরণ কার্যনির্বাহী কমিটিতেও বিএসইসি-এর কোনো সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

এই যোগাযোগের অভাবের কারণে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো প্রস্তাবিত একীভূতকরণ বা অবসায়ন সম্পর্কে স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছে কোনো তথ্য প্রকাশ করতে পারেনি। বিনিয়োগকারীরা তাদের কষ্টার্জিত অর্থের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অন্ধকারে রয়েছেন, যা ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট শেয়ারের মূল্যকে তলানিতে নামিয়ে দিয়েছে। এই পরিস্থিতি শেয়ারবাজারে একটি বড় ধরনের আস্থার সংকট তৈরি করেছে, যেখানে বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা গুরুতর ঝুঁকিতে পড়েছে।

নিয়ন্ত্রক সমন্বয়ের অপরিহার্যতা: অতীত থেকে শিক্ষা

শেয়ারবাজার অত্যন্ত সংবেদনশীল, এবং তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানিকে প্রভাবিত করে এমন যেকোনো সিদ্ধান্ত শেয়ারের মূল্য এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থাকে তীব্রভাবে নাড়িয়ে দিতে পারে। এই কারণে, শেয়ারবাজার বিশ্লেষক এবং বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘকাল ধরে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে নিজেদের মধ্যে, বিশেষ করে বিএসইসি-এর সাথে পরামর্শ করার আহ্বান জানিয়ে আসছেন। বিএসইসি-এর সম্পৃক্ততা ছাড়া ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব।

অতীতেও নিয়ন্ত্রক সমন্বয়হীনতার কারণে শেয়ারবাজারকে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে:তিতাস গ্যাসের উদাহরণ (২০১৫): বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বিএসইসি-এর সাথে পরামর্শ ছাড়াই তিতাস গ্যাসের বিতরণ চার্জ কমিয়ে দেয়। এর ফলস্বরূপ, মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে তিতাসের বাজার মূল্য থেকে ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ উধাও হয়ে যায়।

গ্রামীণফোনের অভিজ্ঞতা (২০১৯ ও ২০২২): বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) গ্রামীণফোনকে 'সিগনিফিকেন্ট মার্কেট পাওয়ার' ঘোষণা করে এবং পরে সিম বিক্রি নিষিদ্ধ করে। এই সিদ্ধান্তগুলোর কোনোটিতেই বিএসইসি-এর সাথে পরামর্শ করা হয়নি, অথচ শেয়ারবাজারে সেগুলোর নেতিবাচক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।

করণীয়: একটি বাধ্যতামূলক সমন্বয় প্রক্রিয়া

বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মন্ত্রণালয়কে এমন একটি বাধ্যতামূলক প্রক্রিয়া স্থাপন করতে হবে যা নিশ্চিত করবে যে, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আয় বা অস্তিত্বকে প্রভাবিত করতে পারে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সমস্ত নিয়ন্ত্রক বিএসইসি-এর সাথে পরামর্শ করবে। যদি তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো মূল্য-সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করতে আইনত বাধ্য থাকে, তবে নিয়ন্ত্রকদেরও উচিত সময়মতো তথ্য প্রকাশ এবং পারস্পরিক পরামর্শ নিশ্চিত করা।

এখন পর্যন্ত, পাঁচটি ব্যাংকের একীভূতকরণ এবং নয়টি এনবিএফআই-এর অবসায়ন সম্পর্কে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)-এর প্ল্যাটফর্মে কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য প্রকাশিত হয়নি। গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পরেই ডিএসই এ বিষয়ে খোঁজ নেওয়া শুরু করে, যেখানে কিছু প্রতিষ্ঠান প্রক্রিয়া বন্ধ করার চেষ্টা করছে বলে জানায়, আবার কিছু প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনো তথ্য পায়নি বলে উল্লেখ করে। নিয়ন্ত্রকদের এই ধরনের অস্বচ্ছতা এবং অসমন্বিত আচরণ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আরও বেশি অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।

আর্থিক খাতে অনেক সংস্কার সাধিত হলেও, একটি মৌলিক সংস্কার এখনও অধরা রয়ে গেছে: এমন একটি প্রক্রিয়া যা তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর স্বার্থ রক্ষায় সমস্ত নিয়ন্ত্রককে বিএসইসি-এর সাথে সমন্বয় সাধন করতে বাধ্য করবে। যতক্ষণ পর্যন্ত এই অত্যাবশ্যকীয় সমন্বয় প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত বিনিয়োগকারীরা তাদের পুঁজির নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই থাকবেন, এবং শেয়ারবাজারকে নিয়ন্ত্রক সমন্বয়হীনতার গুরুতর মূল্য দিতে হবে। দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থার জন্য এই সমস্যাটির দ্রুত সমাধান অপরিহার্য।

আব্দুর রহিম/

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ