ঢাকা, শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫, ২৬ আশ্বিন ১৪৩২

MD Zamirul Islam

Senior Reporter

শেয়ারবাজারে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার কারসাজি: বিএসইসি-এর নতুন তদন্তে তোলপাড়

শেয়ারনিউজ ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ অক্টোবর ১১ ১৭:১৭:৪০
শেয়ারবাজারে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার কারসাজি: বিএসইসি-এর নতুন তদন্তে তোলপাড়

দেশের শেয়ারবাজারে প্রায় ৬ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকার সন্দেহজনক বিনিয়োগকে কেন্দ্র করে এক নতুন তদন্ত শুরু করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এর প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে এই তদন্তে ব্যাংক থেকে অনিয়মিত ঋণ নিয়ে কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারমূল্য কৃত্রিমভাবে বাড়ানোর অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে। এই ঘটনা বিনিয়োগ মহলে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।

বিএফআইইউ এর উদ্বেগজনক তথ্য:

বিএফআইইউ তাদের অনুসন্ধানে জানতে পেরেছে যে, নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি প্রায় ৬ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছে। এই অর্থের একটি বড় অংশই ব্যাংক থেকে নেওয়া অনিয়মিত ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিএফআইইউ আশঙ্কা করছে যে, এই বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যবহার করে বাজারে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের প্রতারিত করা হয়েছে। এই বিষয়ে বিএফআইইউ বিএসইসি-কে বিস্তারিত তথ্য পাঠিয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসি চার সদস্যের একটি বিশেষ কমিটি গঠন করেছে।

বিএসইসি-এর তদন্তের পরিধি:

বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে এবং শেয়ারবাজারের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বিএসইসি গঠিত এই কমিটি আগামী ৬০ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেবে। কমিটির মূল লক্ষ্য থাকবে এই বিনিয়োগের উৎস, এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং শেয়ার কারসাজির সুনির্দিষ্ট অভিযোগগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখা।

কারসাজির অভিনব উপায়:

তদন্তে উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বেনামে এবং অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়েছেন। এরপর সেই ঋণকৃত অর্থ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবগুলোতে জমা করে পর্যায়ক্রমে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ব্যাংকিং ও ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে জটিল কারসাজির জাল বোনা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

কারাগারে অভিযুক্তরা এবং বাজারে আজীবন নিষেধাজ্ঞা:

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই ঋণ ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত একাধিক মামলায় জড়িত ব্যক্তিরা গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে আছেন। একই সাথে, তাদের শেয়ারবাজারে আজীবনের জন্য 'পারসনা নন গ্রাটা' বা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে, ফলে তারা আর কখনও শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট কোনো কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন না।

তদন্তে চিহ্নিত ৮টি প্রতিষ্ঠান:

তদন্তে যে আটটি প্রতিষ্ঠানকে এই শেয়ারবাজার কারসাজি ও অস্বাভাবিক বিনিয়োগের সঙ্গে জড়িত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: অ্যাবসলুট কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, অ্যাপোলো ট্রেডিং, বেসিকমকো হোল্ডিংস, জুপিটার বিজনেস, নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ, ক্রিসেন্ট, ট্রেডনেক্সট ইন্টারন্যাশনাল এবং সেন্ট্রাল ল্যান্ড অ্যান্ড বিল্ডিং। এই প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ এবং পরিচালনা পর্ষদে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে কারসাজিতে অংশ নিয়েছে বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

বেসিকমকো গ্রুপের ভূমিকা ও জরিমানার চিত্র:

তদন্তে বিশেষভাবে বেসিকমকো গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শেয়ার কারসাজি এবং কৃত্রিম মূল্য বৃদ্ধির সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই কারসাজিতে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোকে মোট ৪২৮ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে অ্যাপোলো ট্রেডিং, জুপিটার বিজনেস, ক্রিসেন্ট এবং ট্রেডনেক্সট ইন্টারন্যাশনালকে পৃথকভাবে জরিমানা করা হয়।

জরিমানা আদায়ে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ:

তবে, এই বিপুল অঙ্কের জরিমানা আদায়ে আইনি জটিলতা দেখা দিয়েছে। বিএসইসি-এর একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো জরিমানার পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছে। কিছু প্রতিষ্ঠান আদালতে রিট পিটিশনও দায়ের করে স্থিতাবস্থা আদায় করেছে, যার ফলে জরিমানা আদায়ের প্রক্রিয়া বর্তমানে স্থগিত বা বিলম্বিত হয়ে পড়েছে।

বেসিকমকো গ্রুপের নীরবতা ও আর্থিক সংকট:

এ বিষয়ে বেসিকমকো গ্রুপের কর্মকর্তারা মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, এই বিনিয়োগ সংক্রান্ত সব সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম পূর্বে সরাসরি গ্রুপের প্রধান ব্যক্তি নিজেই তদারকি করতেন। সরকারের পরিবর্তনের পর থেকে এসব শেয়ার ও বন্ড বিক্রি করতে না পারায় গ্রুপের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তীব্র পুঁজিসঙ্কটে ভুগছে।

বাজারের ভবিষ্যৎ এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা:

এই উচ্চপর্যায়ের তদন্ত দেশের শেয়ারবাজারের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই তদন্তের ফলাফল বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের কারসাজি রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দেশের বিনিয়োগকারীরা অধীর আগ্রহে এই তদন্ত কমিটির পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করছেন।

আল-মামুন/

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ