ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২

MD. Razib Ali

Senior Reporter

একীভূতব্য ব্যাংকের শেয়ারে রহস্যময় গতি: দরপতনের পর আজ হল্ট

শেয়ারনিউজ ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ অক্টোবর ১৪ ১৫:৪৬:১১
একীভূতব্য ব্যাংকের শেয়ারে রহস্যময় গতি: দরপতনের পর আজ হল্ট

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করে নতুন একটি ব্যাংক গঠনের প্রস্তাবে অনুমোদন দেওয়ার পর থেকেই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এই ব্যাংকগুলোর শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। একীভূতকরণের ঘোষণার পর গত দুই কার্যদিবস ধরে টানা দরপতনের শিকার হওয়ার পর আজ, মঙ্গলবার, অপ্রত্যাশিতভাবে এই পাঁচটি ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন ঊর্ধ্বমুখী সার্কিট ব্রেকার অতিক্রম করে সাময়িকভাবে হল্টেড হয়েছে। যদিও এই আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধি বাজারের মৌলিক চিত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

একীভূতকরণের প্রস্তাব ও নতুন ব্যাংকের রূপরেখা:

গত বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের এক বৈঠকে পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করে একটি নতুন ব্যাংক গঠনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এই পাঁচটি ব্যাংক বিলুপ্ত করে নতুন একটি শক্তিশালী ব্যাংক গঠিত হবে, যার প্রাথমিক অনুমোদিত মূলধন হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। নতুন ব্যাংকটি বিলুপ্ত হওয়া পাঁচটি ব্যাংকের সমস্ত দায় ও সম্পত্তি গ্রহণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। পরিশোধিত মূলধনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, ২০ হাজার কোটি টাকা, সরকার সরবরাহ করবে। এর মধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকা নগদে এবং বাকি ১০ হাজার কোটি টাকা সুকুক বন্ডের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে।

শেয়ারহোল্ডারদের অনিশ্চয়তা ও বাজারের প্রতিক্রিয়া:

এই একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, সরকার কর্তৃক এই ব্যাংকগুলো বিলুপ্ত করার পর সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা এখনো স্পষ্ট করা হয়নি। এই অনিশ্চয়তার কারণে শেয়ারবাজারে ব্যাংক পাঁচটির শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা গভীর উদ্বেগে রয়েছেন। একীভূতকরণের ঘোষণার পর থেকেই ব্যাংকগুলোর শেয়ারের দামে লাগাতার পতন শুরু হয়।

গত রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) দরপতনের শীর্ষ ১০ কোম্পানির তালিকায় এই পাঁচটি ব্যাংকের মধ্যে তিনটিই ছিল। সোমবারও প্রতিটি ব্যাংকই মূল্য হারিয়েছে। দুই কার্যদিবসের এই ধারাবাহিক পতনের পর আজ হঠাৎ করেই সবকটি ব্যাংক ঊর্ধ্বমুখী সার্কিট ব্রেকার ছুঁয়ে হল্টেড হয়েছে, যা বাজারের সাধারণ প্রবণতার বিপরীতে একটি বিস্ময়কর ঘটনা। এর ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একদিকে যেমন স্বস্তি, অন্যদিকে এই আকস্মিক বৃদ্ধির পেছনে কোনো কৃত্রিম কারণ রয়েছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

বিএসইসির হস্তক্ষেপ ও বিনিয়োগকারী সুরক্ষার দাবি:

দেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে লেখা এক চিঠিতে বিএসইসি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে যে, ব্যাংকগুলোর বর্তমান নাজুক অবস্থার জন্য সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কোনোভাবেই দায়ী নন। তাই একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। বিএসইসির সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে:

ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্সশিটে প্রদর্শিত সম্পদের পাশাপাশি লাইসেন্স, শাখা নেটওয়ার্ক, গ্রাহকসংখ্যা, মানবসম্পদ এবং ব্র্যান্ড ভ্যালুর মতো অস্পৃশ্য সম্পদগুলোরও যথাযথ মূল্যায়ন নিশ্চিত করা। ব্যাংকগুলোর একটি ন্যায্য বিক্রয়মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। ব্যাংকগুলোর ঋণের বিপরীতে সংরক্ষিত আমানত এবং বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের স্থায়ী-অস্থায়ী সম্পত্তি ক্রোক করে আদায়যোগ্য অর্থ বিবেচনায় নিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা। শেয়ারের বাজারমূল্য বা ফেসভ্যালুর মধ্যে যেটি বেশি, সেটিকে ভিত্তি ধরে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা অর্থের সুরক্ষা এবং সেই অনুযায়ী একীভূতকরণের অনুপাত নির্ধারণ করা।

বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে শেয়ারবাজার থেকে তালিকাচ্যুত (Delist) না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্যসোমবার (১৩ অক্টোবর) অর্থ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, একটি স্বার্থান্বেষী মহল গুজব ছড়াচ্ছে যে একীভূতকরণে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তবে সরকার এখনো বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। বরং বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলছে।

এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে যে, একীভূতকরণ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার আগে বিএসইসির পরামর্শ গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করা হবে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে।

পাঁচটি দুর্বল ব্যাংকের একীভূতকরণ নিঃসন্দেহে দেশের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এই ব্যাংকগুলোর সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা নিশ্চিত করা এই প্রক্রিয়ার একটি অপরিহার্য অংশ। গত দুই দিনের দরপতনের পর আজকের আকস্মিক 'হল্ট' পরিস্থিতিকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধি মৌলিক ভিত্তির চেয়ে অনুমাননির্ভর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ নিরসনে একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত।

তানভির ইসলাম/

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ