ঢাকা, বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫, ২৮ কার্তিক ১৪৩২

নবীজির (সা.) সুন্নতে বিয়ে: যে ৫ প্রস্তুতি ছাড়া বিয়ে নয়

ধর্ম ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ নভেম্বর ১২ ১২:৪১:০২
নবীজির (সা.) সুন্নতে বিয়ে: যে ৫ প্রস্তুতি ছাড়া বিয়ে নয়

মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ চুক্তিগুলোর মধ্যে একটি হলো বিয়ে। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে, এই বন্ধন শুধু দুটি পরিবারের মিলন নয়, বরং এটি নবী (সা.)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি ও ইবাদত হিসেবে গণ্য। এই আধ্যত্মিক সম্পর্ককে সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমেই একজন মুমিনের দ্বীন রক্ষার অর্ধেক অংশ পূর্ণ হয়।

রাসুলুল্লাহ (সা.) এই সম্পর্কের গুরুত্ব বর্ণনা করে বলেছেন—

النِّكَاحُ مِنْ سُنَّتِي، فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي‘বিয়ে আমার সুন্নত। যে আমার সুন্নত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে আমার অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (ইবন মাজাহ ১৮৪৬)

দাম্পত্যের ভিত্তি: সাকিনা, মাওয়াদ্দাহ ও রহমাহ

বিয়ের মাধ্যমে একজন মানুষ জীবনে কী প্রত্যাশা করবে, তা কোরআনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। সফল বিবাহের মূলমন্ত্র অর্জনের জন্য মনকে প্রস্তুত করা অপরিহার্য। আল্লাহ তাআলা কোরআনে ঘোষণা করেন—

وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً‘তিনিই তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া স্থাপন করেছেন।’ (সুরা আর-রূম: আয়াত ২১)

এই আয়াতে উল্লিখিত তিনটি মূল উপাদান হলো— সাকিনা (মনো-দৈহিক প্রশান্তি), মাওয়াদ্দাহ (গভীর ভালোবাসা) এবং রহমাহ (করুণা ও দয়া)। এই উপাদানগুলো জীবনসঙ্গীর মাধ্যমে লাভ করার জন্যই বিয়ের আগে একজন ব্যক্তিকে মানসিকভাবে সজ্জিত হতে হবে।

যুবকদের জন্য নবীজির (সা.) সুস্পষ্ট নির্দেশনা

বিয়ের জন্য উৎসাহ প্রদান করার পাশাপাশি রাসুলুল্লাহ (সা.) এই বন্ধনে প্রবেশের জন্য প্রস্তুতিরও নির্দেশনা দিয়েছেন। একজন তরুণের জন্য আর্থিক সামর্থ্যের পাশাপাশি মানসিক ও আত্মিক দৃঢ়তা অর্জন করা অত্যাবশ্যক।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ مَنِ اسْتَطَاعَ مِنكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ‘হে যুবকগণ! তোমাদের মধ্যে যে বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে, সে যেন বিয়ে করে।’ (বুখারি ৫০৬৫, মুসলিম ১৪০০)

সফল বিবাহের জন্য অপরিহার্য ৫টি মানসিক গুণ

মানসিক প্রস্তুতিকে আরও শক্তিশালী করার জন্য ইসলাম ৫টি গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতি মনোযোগ দিতে বলেছে:

১. নতুন জীবনের কর্তৃত্ব ও দায়িত্বের চেতনা

বিবাহিত জীবন কেবল প্রেমের গল্প নয়, বরং এটি একটি সুসংগঠিত দায়িত্বের কাঠামো। মুসলিম পুরুষ ও নারীকে অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে, তারা একে অপরের জন্য নিরাপদ আশ্রয় হতে চলেছে। শুধু ভালোবাসা দিয়ে নয়, বরং মানসিক প্রস্তুতি হিসেবে দায়িত্বের গুরুত্ব অনুধাবন করা জরুরি। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন—

الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ‘পুরুষগণ নারীদের অভিভাবক ও দায়িত্বশীল।’ (সুরা আন-নিসা: আয়াত ৩৪)

২. সহনশীলতা ও মার্জনা করার অভ্যাস

পৃথিবীর কোনো মানুষই ত্রুটিমুক্ত নয়, তাই দাম্পত্য জীবনে ভুল-বোঝাবুঝি আসা স্বাভাবিক। এই অবস্থায় ধৈর্য ও ক্ষমাশীলতার গুণই সম্পর্ককে রক্ষা করতে পারে। বিয়ের আগে এই গুণগুলো অর্জন করা মনকে স্থিতিশীল করে।রাসুলুল্লাহ (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন—

لَا يَفْرَكْ مُؤْمِنٌ مُؤْمِنَةً إِنْ كَرِهَ مِنْهَا خُلُقًا رَضِيَ مِنْهَا آخَرَ‘কোনো মুমিন যেন তার স্ত্রীকে ঘৃণা না করে। যদি তার কোনো দোষ অপছন্দ হয়, তবে অন্য গুণ নিশ্চয়ই পছন্দ হবে।’ (মুসলিম ১৪৬৯)

৩. নৈতিকতা ও তাকওয়াকে সর্বাগ্রে রাখা

বর্তমান সমাজ সাধারণত বাহ্যিক আকর্ষণ বা ধন-সম্পদকে গুরুত্ব দিলেও, ইসলামে বিবাহের ক্ষেত্রে প্রকৃত সৌন্দর্য হলো চরিত্র ও আল্লাহভীতি (তাকওয়া)। পবিত্র নৈতিকতা ও তাকওয়াই একটি সংসারকে জান্নাতমুখী করে।রাসুলুল্লাহ (সা.) পরামর্শ দিয়েছেন—

إِذَا جَاءَكُمْ مَنْ تَرْضَوْنَ دِينَهُ وَخُلُقَهُ فَزَوِّجُوهُ‘যখন এমন কেউ প্রস্তাব দেয় যার দ্বীন ও চরিত্র তোমাদের পছন্দ হয়, তাহলে তাকে বিয়ে কর।’ (তিরমিজি ১০৮৪)

৪. পরামর্শ ও বোঝাপড়ার মানসিকতা গঠন

বিয়ের আগে নিজের বক্তব্য প্রকাশের পাশাপাশি সঙ্গীর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার অভ্যাস গড়ে তোলা দাম্পত্য সম্পর্কের প্রাণ। ভালো যোগাযোগ পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়া তৈরি করে। আল্লাহ তাআলা এক্ষেত্রে পরামর্শের গুরুত্ব দিয়ে বলেন—

وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ‘তুমি তাদের সাথে পরামর্শ করো।’ (সুরা আল-ইমরান: আয়াত ১৫৯)

৫. আল্লাহর ওপর আস্থা ও প্রার্থনার অভ্যাস

বিয়ে মানুষের সিদ্ধান্তের পাশাপাশি ভাগ্যের অংশ। তাই বিয়ের সব প্রক্রিয়ায় আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা রাখা এবং দোয়া করা মুমিনের জন্য অপরিহার্য।আল্লাহ তাআলা বলেছেন—

وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ‘মুমিনদের উচিত আল্লাহর ওপরই ভরসা করা।’ (সুরা আল-ইমরান: আয়াত ১২২)

তাই জীবনসঙ্গী নির্বাচনের আগে সর্বোত্তম প্রার্থনা হলো—

উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মাখতার লি ওয়া লা তুখাইয়্যের আলাইয়্যা।’

অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমার জন্য আপনি পছন্দ করুন, আমাকে নিজের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেবেন না।’

পোশাকের উপমা: বিবাহের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য

দাম্পত্য সফল হয় তখনই, যখন স্বামী-স্ত্রী উভয়ই একে অপরের জন্য দয়া, শান্তি ও নিরাপত্তার উৎস হয়ে ওঠে। এই পবিত্র বন্ধনকে আল্লাহ এক সুন্দর উপমা দিয়ে বর্ণনা করেছেন—

هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ‘তোমরা একে অপরের জন্য পোশাকস্বরূপ।’ (সুরা আল-বাকারা: আয়াত ১৮৭)

পোশাক যেমন আমাদের দেহকে আবৃত করে ও সুরক্ষা দেয়, ঠিক তেমনি স্বামী-স্ত্রীও একে অপরের ত্রুটি ঢেকে রাখে, মানসিক আশ্রয় যোগায় এবং আল্লাহর রহমতের ছায়ায় তাদের সম্পর্ককে উন্নত করে। এই হলো ইসলামী বিবাহের প্রকৃত সৌন্দর্য ও উদ্দেশ্য।

আল-মামুন/

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ