ঢাকা, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

MD Zamirul Islam

Senior Reporter

মেয়ের দাফন বাদ দিয়ে স্ত্রীর জন্য হাসপাতাল খুঁজছেন বাবা আবদুল হক

সারাদেশ ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ নভেম্বর ২২ ০১:০০:৩১
মেয়ের দাফন বাদ দিয়ে স্ত্রীর জন্য হাসপাতাল খুঁজছেন বাবা আবদুল হক

শুক্রবার সকালে আকস্মিক ভূমিকম্প নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকায় এক ব্যবসায়ী পরিবারে চরম বিপর্যয় ডেকে এনেছে। কাঁচামাল বিক্রেতা আব্দুল হক একদিকে হারিয়েছেন তাঁর ১০ মাস বয়সী শিশুকন্যা ফাতেমাকে, অন্যদিকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় থাকা স্ত্রী কুলসুম বেগমকে (৩০) নিয়ে হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। এই হৃদয়বিদারক পরিস্থিতিতে, মেয়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে।

ভূমিকম্পে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল দেয়াল

গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের ইসলামবাগ ৫ নম্বর ক্যানেল এলাকায় আজ শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ঘটে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। কুলসুম বেগম তাঁর তিন বছর বয়সী বড় কন্যা নুজাইবা জান্নাতের খোঁজ নিতে বাবার বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। ভাড়া বাসার কাছাকাছি দূরত্বে থাকা নুজাইবা ছিল তাঁর দাদু বাড়িতে। ১০ মাসের কন্যা ফাতেমাকে কোলে নিয়ে কুলসুম দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়েই সড়কের পাশে ধ্বসে পড়া একটি সীমানা প্রাচীরের নিচে চাপা পড়েন।

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র জানায়, ভূকম্পন শুরু হতেই আতঙ্কিত কুলসুম যখন শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে মায়ের বাসার দিকে যাচ্ছিলেন, তখন প্রতিবেশী জেসমিন বেগমও ভয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে সড়কে আশ্রয় নেন। ঠিক সেই মুহূর্তে রাস্তার ধারের প্রায় ১০ ফুট উঁচু প্রাচীরটি তাঁদের ওপর আছড়ে পড়ে। ইটের প্রচণ্ড চাপে ঘটনাস্থলেই শিশু ফাতেমার মাথার গুরুতর জখম হয় এবং মৃত্যু ঘটে। নিহত ফাতেমা আবদুল হকের মেয়ে।

স্থানীয় বাসিন্দা ইমতিয়াজ রনি নিশ্চিত করেন, ‘ঘটনার সময় ফাতেমা মায়ের কোলে ছিল। আমরাই ইটের স্তূপের নিচ থেকে শিশুটির মরদেহ বের করি। কুলসুম তখন সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ছিলেন। ফলে ফাতেমার মৃত্যুর খবর তিনি জানতে পারেননি।’

স্ত্রীর জীবন বাঁচাতে বাবার নিরন্তর সংগ্রাম

ব্যবসায়িক কারণে আবদুল হক ঢাকার শ্যামবাজারে ভাড়া বাসায় থাকেন। তাঁর স্ত্রী কুলসুম দুই মেয়েকে নিয়ে পিতার বাড়ির কাছে একটি বাসাতে থাকতেন। দুই কন্যাকে মাদ্রাসায় শিক্ষাদানের স্বপ্ন দেখেছিল এই পরিবারটি। কিন্তু মুহূর্তের ভূমিকম্পে তাদের সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়।

কুলসুমের জীবন বাঁচাতে স্বজনেরা তাঁকে নিয়ে যখন উন্নত চিকিৎসার সন্ধানে রাজধানী অভিমুখে ছুটছেন, তখন মা-বাবার অনুপস্থিতিতেই নিথর ফাতেমার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় অপরাহ্ণে। বর্তমানে অসুস্থ কুলসুম তাঁর স্বামীর ঢাকার ভাড়া বাসায় রয়েছেন এবং আদরের ফাতেমার চিরবিদায়ের খবর তিনি এখনও জানতে পারেননি বলে স্বজনরা জানিয়েছেন।

৯ ঘণ্টা চেষ্টার পরও মেলেনি শয্যা, ১১ হাজার টাকা গচ্ছা

ক্ষতবিক্ষত কুলসুম বেগমের উন্নত চিকিৎসার সন্ধানে দীর্ঘ ৯ ঘণ্টা ধরে স্বজনেরা শুধু প্রাথমিক সেবা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন তাঁরা। কুলসুমের ভগ্নিপতি মোহাম্মদ হোসেন গতকাল রাত আটটায় জানান, প্রথমে বেলা ১১টার দিকে রূপগঞ্জের ইউএস-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁকে নেওয়া হয়। এরপর তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হলেও জরুরি বিভাগে প্রথমিক চিকিৎসা দিয়ে জানানো হয় কোনো শয্যা খালি নেই।

এরপর কুলসুমকে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতাল এবং সবশেষে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতালেও শয্যা না পেয়ে ব্যর্থ হন স্বজনরা। মোহাম্মদ হোসেন উল্লেখ করেন, এই নিরন্তর ছোটাছুটিতে অ্যাম্বুলেন্স বাবদই ১১ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। গুরুতর আহত কুলসুম এখন মাথায় আঘাত নিয়ে কেবল ইশারায় সামান্য সাড়া দিতে পারছেন। প্রত্যাশিত চিকিৎসা না পেয়ে তারা এখন টাকার সংস্থান করে ব্যক্তিগত ক্লিনিকে ভর্তির পরিকল্পনা করছেন।

ত্রুটিপূর্ণ প্রাচীর, প্রশাসনের আর্থিক সহায়তা

দুর্ঘটনার পরপরই রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইফুল ইসলাম দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি সাংবাদিকদের কাছে প্রাচীরটির নির্মাণ ত্রুটি তুলে ধরেন। তাঁর মতে, প্রায় ১০ ফুট উঁচু এই দেয়ালটিতে কোনো স্তম্ভ (পিলার) ব্যবহৃত হয়নি, এমনকি নির্মাণে লোহার রডও ছিল না। এটিই ধসের মূল কারণ। উপজেলা প্রশাসন মৃত ফাতেমার দাফন প্রক্রিয়ার জন্য পরিবারকে ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে।

আহত কুলসুমের চিকিৎসা না পাওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে ইউএনও সাইফুল ইসলাম রাত নয়টায় দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, তিনি শুনেছিলেন কুলসুমকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে। পরে শয্যা না পাওয়ার বিষয়টি জেনে তিনি বলেন, ‘চিকিৎসা না পাওয়াটা দুঃখজনক। আমরা কুলসুমের চিকিৎসার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’

আল-মামুন/

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ