MD. Razib Ali
Senior Reporter
ভূমিকম্পে ঢাকা কেন ঝুঁকিপূর্ণ? বিশেষজ্ঞরা দিলেন ভয়াবহ তথ্য
রাজধানী ঢাকা একটি প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের তীব্র আঘাত সহ্য করার মতো সক্ষমতা রাখে না। নগর বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, নিয়ন্ত্রণহীন নগরায়নের কারণে ঢাকা শহরে ভূকম্পনজনিত ক্ষতির আশঙ্কা অত্যন্ত বেশি। যদি একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে, তবে এই মেগাসিটি এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। পরিস্থিতি সামাল দিতে যত দ্রুত সম্ভব জরুরি ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশাল আঘাতের পূর্বাভাস ও অবকাঠামোগত ত্রুটি
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরিচালিত 'আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্টের' একটি জরিপ বড় ধরনের ক্ষতির চিত্র তুলে ধরেছে। জরিপের তথ্য অনুসারে, যদি ঢাকার নিকটবর্তী মধুপুর ফল্টে (টাঙ্গাইল) ৬.৯ মাত্রার ভূকম্পন আঘাত হানে, তবে ঢাকা শহরের কয়েক লাখ স্থাপনা মাটিতে মিশে যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতির প্রধান কারণ হলো— অধিকাংশ ভবন নির্মাণে জাতীয় ভবন নির্মাণ কোড (National Building Code) অনুসরণ না করা। পাশাপাশি, বেশিরভাগ স্থাপনার ক্ষেত্রেই সরকারি কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমোদন নেওয়া হয়নি।
অনুমোদনহীন ভবনের ভয়ঙ্কর পরিসংখ্যান
রাজউকের জরিপ অনুযায়ী, রাজধানীতে বর্তমানে ২১ লাখ ৪৫ হাজার ভবন রয়েছে। এর মধ্যে একটি বিশাল অংশ অনুমোদিত নকশা এবং নির্মাণ কোড লঙ্ঘন করে তৈরি হয়েছে:
বিশাল অংশ: ৯৫ শতাংশ ভবন নির্মাণ করা হয়েছে অনুমোদিত নকশার বাইরে গিয়ে।
ড্যাপের হিসাব: নগরীর মাস্টারপ্ল্যান ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ)-এর তথ্যমতে, ২০০৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৯৫ হাজার নতুন স্থাপনা তৈরি হয়েছে। এই সময়কালে রাজউক মাত্র ৪ হাজার ১৪৭টি ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছিল। অর্থাৎ, ওই সময়ে ৯৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ ভবন অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণ করা হয়েছে।
রাজধানীর বসিলার পাশাপাশি ঢাকা উদ্যান ও কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন প্রান্তেও শত শত ভবন অনুমোদন ব্যতিরেকেই মাথা উঁচু করেছে। তবে রাজউক চলতি বছর প্রায় সাড়ে ৩ হাজার অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে।
ভূমিকম্পের ঝুঁকির নেপথ্যে দুর্বলতার তালিকা
ভূমিকম্পে ঢাকার সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি বৃদ্ধির জন্য বিশেষজ্ঞরা একাধিক কারণ চিহ্নিত করেছেন:
অপরিকল্পিত বহুতল: বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এই মহানগরীতে অপরিকল্পিতভাবে বহুতল ভবন, বস্তি এবং সরু রাস্তাগুলো গড়ে উঠেছে।
নিরাপত্তা মানদণ্ড লঙ্ঘন: অনেক ভবনই ভূমিকম্প সুরক্ষা মানদণ্ড মেনে তৈরি হয়নি, ফলে এগুলো সামান্য কম্পনেই মৃত্যুফাঁদে পরিণত হতে পারে।
মাটির তরলীকরণ ঝুঁকি: বাংলাদেশের মাটির গঠনগত দুর্বলতা একটি বড় ঝুঁকি। দেশের প্রধান অংশই আলগা ও জলাবদ্ধ পলিমাটির ওপর গঠিত। শক্তিশালী কম্পনের সময় এই মাটি তরলীকৃত (Liquefaction) হয়ে ভবন ধসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতায় থাকা অধিকাংশ ভবনই ২০ থেকে ৩০ বছর পূর্বে নির্মিত। এসব স্থানে রড-সিমেন্টের মান নিয়ন্ত্রণ না করা ও অনুমোদিত নকশার বাইরে ভবন তৈরি হওয়ায় সামান্য কম্পনেও বড় ক্ষতির আশঙ্কা করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
৫.৭ মাত্রার কম্পনে ১৪টি ভবনের ক্ষতি
শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সংঘটিত ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের জেরেই ১৪টি ভবনে ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসার মো. সালাহ উদ্দীন-আল-ওয়াদুদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, মালিবাগ চৌধুরী পাড়া, আরমানিটোলা, সূত্রাপুরের স্বামীবাগ, বনানী, কলাবাগান, বসুন্ধরা, নর্দ্দা, দক্ষিণ বনশ্রী, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, মগবাজারের মধুবাগ এবং হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় ১টি করে এবং খিলগাঁও এলাকায় ২টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী এই ভূমিকম্পটিকে বড় ভূমিকম্পের আগে হওয়া ছোট ছোট কম্পনের একটি অংশ বলে উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রায় এই ক্ষতি হলে, ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে এবং বিপুল প্রাণহানি ঘটবে।
নগর পরিকল্পনাবিদদের কঠোর বার্তা ও করণীয়
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, রাজধানীতে গড়ে ওঠা ভবনগুলো ভূমিকম্প সহনীয় কি না, তা নির্ণয়ের জন্য রাজউকের কাছে পর্যাপ্ত জনবল ও যন্ত্রপাতি নেই। রাজউক অনুমোদনহীন ভবনের সঠিক সংখ্যা এবং খাল-বিল-নদী দখল করে তৈরি হওয়া স্থাপনার সংখ্যাও জানে না।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খানের মতে, এই ভূমিকম্প বিপদ নিকটবর্তী হওয়ার বার্তা দিচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, ভূমিকম্পের মতো বড় দুর্যোগে জনসাধারণের আশ্রয় নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ ও খোলা জায়গার অভাব ঢাকা শহরের এক মারাত্মক সমস্যা।
জরুরি পদক্ষেপের সুপারিশ:
বিল্ডিং কোড অনুসরণ: জরুরি ভিত্তিতে কঠোরভাবে ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড ও নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করতে হবে।
বিধিমালা কর্তৃপক্ষ: বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি (বিবিআরএ) গঠন করে দ্রুত বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
ঝুঁকিপূর্ণ ভবন উচ্ছেদ: পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর তালিকা প্রকাশ ও রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত সব বিপজ্জনক ভবন দ্রুত খালি করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
নিম্নাঞ্চলে নির্মাণ নিষেধাজ্ঞা: জলাধার, বেসিন এলাকা বা পানি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন স্থান ভরাট করে কোনো ধরনের উন্নয়ন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে।
ড. আব্দুল লতিফ হেলালী, যিনি আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের সাবেক প্রকল্প পরিচালক ছিলেন, তিনি জানিয়েছেন, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করতে মাটির গুণগতমান পরীক্ষা করে একটি রিস্ক সেনসিটিভ ল্যান্ড ইউজ প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে এবং ভূমিকম্প সহনীয় ব্যবস্থা ও ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পরীক্ষার জন্য ‘আরবান সেফটি অ্যান্ড রেজিলেন্স ইনস্টিটিউট’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় আছে।
রাজউকের খসড়া নীতিমালা ও ড্যাপের সংশোধন
রাজউকের আওতাধীন লাখ লাখ নকশাবিহীন স্থাপনার বিষয়ে সংস্থাটি একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করেছে। এই নীতিমালায় প্রস্তাব করা হয়েছে— ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড, রাজউকের মাস্টার প্ল্যান ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করে গড়ে ওঠা ভবনগুলোকে বৈধতা দেওয়া হবে। তবে এক্ষেত্রে বিদ্যমান নকশা অনুমোদন ফি’র তিন থেকে পাঁচ গুণ জরিমানা আরোপের সুপারিশ করা হয়েছে।
রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম জানিয়েছেন, বিধিবহির্ভূত ৩ হাজার ৩৮২টি ভবন চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের পর ফাটল চিহ্নিত করতে এলাকাভিত্তিক কর্মকর্তাদের মাঠে নামানো হয়েছে।
ড্যাপ নীতিগতভাবে অনুমোদন:
সরকার সম্প্রতি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধনের প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে। এই সংশোধিত পরিকল্পনায়:
ঢাকাকে ৬৮টি ব্লকে (আগের ২৭৫টির পরিবর্তে) বিভক্ত করা হয়েছে।
ভবনের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং সর্বোচ্চ জনঘনত্ব ২৫০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ করা হয়েছে।
বহু এলাকায় ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন ১০ থেকে ১১ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
নতুন শর্ত: কোনো প্লটে যত বেশি খোলা জায়গা রাখা হবে, উচ্চতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সেই অনুপাতে অতিরিক্ত ছাড় দেওয়া হবে।
এছাড়া নতুন বিধিমালায় পাঁচ কাঠা বা তার বেশি জমির প্লটে স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি) স্থাপন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পুরোনো নিয়মে ৪৫ দিনের পরিবর্তে আবেদন নিষ্পত্তির সময় এখন ১৮০ দিন করা হয়েছে। তবে অকুপ্যান্সি সার্টিফিকেট এখন একবার নিলেই তা আজীবনের জন্য কার্যকর থাকবে।
ঢাকার কাছাকাছি ভূমিকম্পের ঐতিহাসিক নথি
ঢাকার কাছেই শক্তিশালী ভূমিকম্পের অতীত ইতিহাস রয়েছে। ভূমিকম্প শনাক্তকারী সংস্থা আর্থকোয়েক ট্র্যাকের নথি অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে ঢাকার কাছে ফরিদপুরে দুইবার ৪-এর বেশি মাত্রার ভূকম্পন নথিবদ্ধ হয়েছে।
শক্তিশালী কম্পন: গত ১৫-২০ বছরের মধ্যে ঢাকার কাছে সবচেয়ে শক্তিশালী হিসেবে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জে ৫.১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প নথিবদ্ধ হয়।
ঐতিহাসিক কম্পন: ১৮৮৫ সালে ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জে ৭.৫ মাত্রার এবং ১৮২২ ও ১৯১৮ সালে ঢাকার অদূরে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্পের ইতিহাস রয়েছে।
সবশেষ কম্পন: সবশেষ শুক্রবারের ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার কাছের নরসিংদীর মাধবদীতে।
আল-মামুন/
পাঠকের মতামত:
আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ
- ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা ২য় ওয়ানডে: খেলাটি সরাসরি দেখুন Live
- বাংলাদেশ বনাম আজারবাইজান: ৯০ মিনিটের খেলা শেষ, জানুন ফলাফল
- earthquake today: আবারো ৪.২ তীব্রতার ভূমিকম্প
- ব্রাজিল বনাম বাংলাদেশ ম্যাচ কবে, জানুন সময়সূচি
- বাংলাদেশ বনাম আয়ারল্যান্ড ৩য় টি-২০: খেলাটি সরাসরি দেখুন Live
- খালেদা জিয়ার সর্বশেষ অবস্থা জানালেন ব্যক্তিগত চিকিৎসক জাহিদ হোসেন
- বাংলাদেশ বনাম আয়ারল্যান্ড ৩য় টি-২০: কখন, কোথায় ও কীভাবে দেখবেন লাইভ
- কঠোর শাস্তির মুখে শিক্ষকরা: পরীক্ষা বন্ধের জেরে কঠোর অবস্থানে সরকার
- আর্জেন্টিনা বনাম বাংলাদেশ ম্যাচ কবে, জানুন সময়সূচি
- আজকের সোনার দাম: (মঙ্গলবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৫)
- আজ বাংলাদেশ বনাম আজারবাইজান ম্যাচ: সরাসরি Live দেখার উপায়
- আজ বাংলাদেশ বনাম আজারবাইজান ম্যাচ: সরাসরি দেখার উপায় ও সময়সূচি
- বিশ্ববাজারে কমলো স্বর্ণ-রুপার দাম, বাংলাদেশে স্বর্ণের ভরি কত
- বাংলাদেশ বনাম আজারবাইজান: প্রথমার্ধের খেলা শেষ, জানুন ফলাফল
- earthquake today: আবারও ভূমিকম্প, উৎপত্তিস্থল কোথায়?