ঢাকা, শুক্রবার, ৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শেয়ারবাজারের ৫ ইসলামী ব্যাংককে এক করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

শেয়ারবাজার ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ জুন ০৫ ১৫:৩১:০৬
শেয়ারবাজারের ৫ ইসলামী ব্যাংককে এক করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

বড় ইসলামি ব্যাংক গঠনে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক, ঈদের পর শুরু একীভূতকরণের প্রক্রিয়া

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বড় পরিসরে একাধিক ইসলামি ব্যাংক একীভূত করে একটি শক্তিশালী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর্থিক সংকটে পড়া পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক—মিলে নতুন এই ব্যাংক গঠিত হবে। এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকার প্রাথমিকভাবে নতুন ব্যাংকের মূলধন জোগাবে এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে (এসএমই) অর্থায়নই হবে ব্যাংকটির প্রধান কাজ।

গতকাল বুধবার (৪ জুন) বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে সংশ্লিষ্ট পাঁচ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) ডেকে এই একীভূতকরণের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত জানানো হয়। আলোচনায় অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংক একীভূত হলেও গ্রাহকদের লেনদেনে কোনো সমস্যা হবে না। তাঁরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন ব্যাংকের গ্রাহকে পরিণত হবেন। তদুপরি শীর্ষ পর্যায় ছাড়া অন্যান্য ব্যাংকাররা একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের চাকরিতে বহাল থাকবেন। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে তিন বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।

কারা মালিক, কেন দুর্বল হলো ব্যাংকগুলো?

একীভূত হওয়ার তালিকায় থাকা পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে এক্সিম ব্যাংকের মালিকানা রয়েছে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ও ‘নিষিদ্ধ’ ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম মজুমদারের হাতে। অপর চার ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে ভারতের পলায়নপর এস আলম গ্রুপ, যাদের সঙ্গে সাবেক সরকারপ্রধানের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। গত সরকার আমলে বিভিন্ন নামে বিপুল অর্থ তুলে নেওয়ার কারণে এসব ব্যাংক আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এসব ব্যাংকে নতুন পর্ষদ বসানো হয়। এক্সিম ব্যাংক ছাড়া বাকি চারটিতে দায়িত্ব পান স্বতন্ত্র পরিচালকরা।

সম্পদের মান নিরীক্ষা, কারা বাদ পড়তে পারে?

বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে ইতিমধ্যে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই পাঁচ ব্যাংকের সম্পদের মান নিরীক্ষা করা হয়েছে। কেউ যদি নিরীক্ষা প্রতিবেদন নিয়ে আপত্তি জানিয়ে নিজেকে আর্থিকভাবে সবল প্রমাণ করতে পারে, তাহলে সেই ব্যাংককে একীভূতকরণের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে। না হলে ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর আওতায় একীভূতকরণ শুরু হবে। আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যে এ প্রক্রিয়া শেষ করতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক।

আমানত-ঋণের ব্যবধান ও খারাপ ঋণ ব্যবস্থাপনা

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত শাখা সংখ্যা ৭৭৯টি, উপশাখা ৬৯৮টি, এজেন্ট ৫০০ এবং এটিএম বুথ রয়েছে ১ হাজারের বেশি। এসব ব্যাংকে কর্মরত জনবল ১৫ হাজারেরও বেশি এবং গ্রাহক হিসাব সংখ্যা ৯২ লাখ। আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা হলেও ঋণ দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য উৎস থেকে ধার করে অতিরিক্ত ঋণ দিয়েছে তারা।

একীভূতকরণের আওতায় যেসব ঋণ ‘খারাপ’ হয়ে পড়েছে, তা হস্তান্তর করা হবে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির (এএমসি) কাছে। লক্ষ্য থাকবে, নতুন ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার যেন ১০ শতাংশের নিচে থাকে। এতে আন্তর্জাতিক লেনদেনের খরচ কমবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন তহবিল থেকেও টাকা নিতে পারবে ব্যাংকটি।

সরকার দেবে মূলধন, পরবর্তী ধাপে শেয়ার ছাড়ার পরিকল্পনা

নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স অনুমোদন দেওয়া হবে ঈদের ছুটির পর। সরকার ও বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় এই ব্যাংকের মূলধন গঠন করা হবে, যার জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। একীভূত ব্যাংকগুলোর সম্পদ ও দায় নতুন ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করা হবে। ধীরে ধীরে শাখাগুলোর একীভূতকরণ এবং জনবল হ্রাস করা হবে। একপর্যায়ে বেসরকারি খাতে শেয়ার ছেড়ে ব্যাংক পরিচালনায় উদ্যোক্তাদের যুক্ত করার পরিকল্পনাও রয়েছে।

কার কী বলছেন?

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, “পাঁচ ব্যাংককে এক করে একটি বড় ইসলামি ব্যাংক গঠনের পরিকল্পনার কথা আমাদের জানানো হয়েছে। তবে কেউ যদি আর্থিকভাবে সুস্থ প্রমাণ দিতে পারে, তাহলে সে তালিকা থেকে বাদ যেতে পারে। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে রাজি।”

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, “দেশে বড় পরিসরে একটি ইসলামি ব্যাংক গঠনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এটা সফল হলে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ে নতুন গতি আসবে।”

অন্যদিকে, ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য ফেরাতে কেবল একীভূতকরণ নয়, জবাবদিহি নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, “যদি রাজনৈতিক লুটপাট অব্যাহত থাকে, তাহলে শুধু ব্যাংক একীভূত করলেই কাজ হবে না। সুশাসন ও কার্যকর সংস্কার ছাড়া স্থায়ী সমাধান আসবে না। গত ৯ মাসেও আর্থিক খাতে পুরোপুরি সুশাসন ফেরেনি।”

ব্যাংক একীভূতকরণ কার্যক্রম নিঃসন্দেহে একটি বড় ও সাহসী উদ্যোগ। তবে এর সফলতা নির্ভর করবে বাংলাদেশ ব্যাংক কতটা কার্যকরভাবে এই প্রক্রিয়া তদারকি করতে পারে এবং ভবিষ্যতে সুশাসন ও জবাবদিহির ধারা কতটা বজায় রাখা হয় তার ওপর। এই নতুন ইসলামি ব্যাংক দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে—তবে তার আগে দরকার আস্থা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।

মো: রাজিব আলী/

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ