ঢাকা, শনিবার, ৫ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২

বাজারে চড়া দামে ইলিশ, পাতে তোলা এখন গরিবের সাধ্য নয়

অর্থনীতি ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ জুলাই ০৫ ১৬:৪০:৩০
বাজারে চড়া দামে ইলিশ, পাতে তোলা এখন গরিবের সাধ্য নয়

নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতীয় মাছ ইলিশ—যে মাছ একসময় মধ্যবিত্ত বাঙালির বৈঠকি খাওয়া-দাওয়ার গর্ব ছিল, এখন তা যেন শুধুই স্মৃতির অংশ। ঢাকার বাজারে ইলিশ মিলছে হাতে গোনা কয়েকটি দোকানে, আর দাম এমন চড়া যে গরিব-মধ্যবিত্তের সাধ্যের বাইরে চলে গেছে।

শনিবার (৫ জুলাই) সকাল ১১টার দিকে রাজধানীর রামপুরা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, যেখানে একসময় একাধিক দোকানে ইলিশ পাওয়া যেত, এখন সেখানে মাত্র একটি দোকানে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। সেখানকার এক কেজি ওজনের একটি ইলিশের দাম চাওয়া হচ্ছে ২ হাজার ৮০০ টাকা, আর ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার টাকায়।

দোকানদার নুর আলম বলেন, “সকালে আড়তে কোনো মাছই পাইনি। এই কয়টা মাছ ঘাট থেকে কিনে এনেছি অনেক কষ্টে। এখন শুধু এইটুকুই আছে।”

তিনি আরও বলেন, “বাকি দোকানগুলোতেও ইলিশ নেই। অনেকে খালি হাতে ফিরেছে, বিক্রি করছে রুই-কাতলা।”

রামপুরা বাজারের পাশের উলুন বাজারেও একই চিত্র। সেখানে একমাত্র একটি দোকানে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। দোকানদার মনির হোসেন জানালেন, “ঈদের পর থেকে ইলিশের দাম অনেক বেড়ে গেছে। আগে যে মাছ ২ হাজার টাকায় বিক্রি করতাম, এখন সেটা ৩ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।”

একজন ক্রেতা দোকানে দাঁড়িয়ে মাছ ওজন করিয়ে আবার রেখে দেন। বলেন, “এই মাছ আমাদের পরিবারে খুব পছন্দ। কিন্তু এখন তো এটা ধনীদের খাবার হয়ে গেছে। আত্মীয় এসেছিল, তাই কিনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এই দামে কিভাবে সম্ভব?”

ইলিশের দামে রেকর্ড উর্ধ্বগতি

ঢাকার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ৩০০–৪০০ গ্রাম সাইজের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায়। ৮০০ গ্রাম ওজনের মাছের দাম ২ হাজার ২০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। আর এক কেজির উপরে উঠলেই দাম ছুঁয়ে যাচ্ছে ৩ হাজার বা তার বেশি।

বিক্রেতাদের দাবি, ইলিশের মৌসুম এখনও পুরোপুরি শুরু হয়নি। এর মধ্যে যে পরিমাণ মাছ বাজারে এসেছে, তা অপ্রতুল। আর সরবরাহ কম থাকায় দামও বেড়েছে দ্বিগুণ।

উৎসে দাম বেঁধে দেওয়ার ভাবনা, ব্যবসায়ীদের হুঁশিয়ারি

ইলিশের লাগামহীন দামে সরকার নড়েচড়ে বসেছে। যেসব জেলায় ইলিশ ধরা হয়, সেখানে উৎস পর্যায়ে দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।

তবে এ সিদ্ধান্তে ক্ষোভে ফুঁসছে চাঁদপুরসহ বড় বড় মাছের মোকাম ও আড়তের ব্যবসায়ীরা। তাদের ভাষ্য, “ইলিশের দাম প্রাকৃতিক, বাজারের ওপর নির্ভর করে। সরকার দাম বেঁধে দিলে আমরা মাছ বিক্রি করব না।”

তারা আরও বলেন, “ঘাট থেকে আনার খরচ, বরফ, পরিবহন, হোটেল-বিল—সব কিছু মিলে আমাদেরও খরচ বাড়ছে। এই অবস্থায় সরকার যদি দাম বেঁধে দেয়, তাহলে ব্যবসা টিকবে না।”

বিশেষজ্ঞদের মত

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক এবং ইলিশ গবেষক মো. আনিছুর রহমান বলেন, “মে ও জুন মাস থেকে কিছু ইলিশ ধরা পড়ে, কিন্তু সেপ্টেম্বর-অক্টোবরই মূল মৌসুম। তাই এখন দাম কিছুটা বাড়া স্বাভাবিক হলেও এতটা নয়। এতে ভোক্তারা মার খাচ্ছেন।”

তিনি আরও বলেন, “মূল সমস্যা বাজার ব্যবস্থাপনায়। উৎসে মাছের দাম বেঁধে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন ও পাইকারি পর্যায়েও নজরদারি বাড়ানো দরকার।”

ইলিশ শুধু একটি মাছ নয়, বাঙালির আবেগ, সংস্কৃতি আর উৎসবের অংশ। কিন্তু এই আবেগ এখন দামি স্বপ্নে পরিণত হচ্ছে। চড়া দামে ইলিশ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেলে জাতীয় মাছ হিসেবে তার মর্যাদাও প্রশ্নের মুখে পড়বে। তাই সংকট সমাধানে প্রয়োজন বাস্তবমুখী ও টেকসই পদক্ষেপ। নইলে পাতে নয়, ইলিশ থাকবে কেবল স্মৃতিতে।

মো: রাজিব আলী/

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ