ঢাকা, বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৯ ভাদ্র ১৪৩২

Alamin Islam

Senior Reporter

হযরত মুহাম্মদ সা. বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে

ধর্ম ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ সেপ্টেম্বর ০২ ০৯:০৭:৫৯
হযরত মুহাম্মদ সা. বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে

মানবতার মুক্তির দিশারী, ইসলামের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমন বার্তা শুধু কুরআন ও হাদিসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বিভিন্ন প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের গভীরে অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, Yahudi (তাওরাত), খ্রিষ্টান (ইঞ্জিল), বৌদ্ধ, পার্শী এমনকি হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের পাতায় পাতায় তাঁর আগমনের সুস্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী লিপিবদ্ধ রয়েছে। এসব ভবিষ্যদ্বাণী কেবল তাঁর জন্ম বা পরিচয় নয়, বরং তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, ধর্মীয় মিশন এবং বিশ্বজনীনতার এক অসাধারণ চিত্র তুলে ধরে। এই বিশেষ প্রতিবেদনটি বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের আলোকে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর এই অভূতপূর্ব উপস্থিতি নিয়ে আলোকপাত করবে।

তাওরাতের পূর্বাভাস: ইব্রাহিম (আ.)-এর দোয়ার বাস্তবায়ন

Yahudi ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ তাওরাত, যা মুসা (আ.)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়, তাতে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। কুরআনের সূরা বাকারা (২:১২৯) স্মরণ করিয়ে দেয়, আল্লাহর নবী হযরত ইব্রাহিম (আ.) মক্কায় কাবাঘর নির্মাণের সময় এক ঐতিহাসিক প্রার্থনা করেছিলেন। তিনি তাঁর বংশধরদের মধ্য থেকে এমন একজন পয়গম্বর চেয়েছিলেন, যিনি তাদের কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের পরিশুদ্ধ করবেন। সূরা ইমরান (৩:১৬৪) ঘোষণা করে, আল্লাহ এই দোয়া কবুল করেছেন এবং মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ করে তাদের মধ্য থেকেই একজন নবী প্রেরণ করেছেন, যিনি আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করেন, পরিশোধন করেন এবং কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেন। এটি নিঃসন্দেহে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতিই ইঙ্গিত।

সূরা আরাফ (৭:১৫৭) আরও স্পষ্ট করে বলে যে, "সে সমস্ত লোক, যারা আনুগত্য অবলম্বন করে এ রসূলের, যিনি উম্মী নবী, যাঁর সম্পর্কে তারা নিজেদের কাছে রক্ষিত তওরাত ও ইঞ্জিলে লেখা দেখতে পায়..."। এই আয়াতটি তাওরাত ও ইঞ্জিলে শেষ নবীর গুণাবলী বিদ্যমান থাকার সাক্ষ্য দেয়।

মাসনাদ আহমদ-এর একটি উল্লেখযোগ্য বর্ণনা এই দাবিকে আরও জোরালো করে। রাসূল (সা.) জনৈক ইয়াহুদি ব্যক্তির কাছে তাওরাতের শপথ করিয়ে জানতে চান যে, তাদের গ্রন্থে তাঁর বিবরণ আছে কিনা। ইয়াহুদিটি প্রাথমিকভাবে অস্বীকার করলেও, তার পুত্র সত্য স্বীকার করে এবং ইসলাম গ্রহণ করে। এটি প্রমাণ করে, তৎকালীন ইয়াহুদিদের মধ্যে অনেকেই তাওরাতে রাসূল (সা.)-এর আগমনী বার্তা সম্পর্কে অবগত ছিলেন।

ইঞ্জিলে আহমদ (সা.)-এর সুসংবাদ: ঈসা (আ.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী

খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বাইবেল, যার একটি অংশ ইঞ্জিল, তাতেও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সূরা সফ (৬১:৬) এ হযরত ঈসা (আ.)-এর একটি ঐতিহাসিক উক্তি বর্ণিত হয়েছে: "স্মরণ কর, যখন মরিয়ম-তনয় ঈসা (আ.) বলল: হে বনী ইসরাইল! আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রসূল, আমার পূর্ববর্তী তওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজন রসূলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন। তাঁর নাম আহমদ।" এখানে 'আহমদ' নামটি সরাসরি উল্লেখ করে রাসূল (সা.)-এর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

বাইবেলের "কিতাবুল ইসতিসনা, অধ্যায়: ১৮, কালাম: ১৭-২২" এ বর্ণিত আল্লাহর উক্তি: "আমি তাদের জন্য তাদের ভাইদের মধ্য থেকে একজনকে নবী বানিয়ে পাঠাবো আর সে আমার কালামকে তাদেরকে পড়িয়ে শুনাবে এবং আমি যা কিছুর হুকুম করব সে তাদেরকে বলে দিবে..."। এই উক্তিটি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমন এবং তাঁর মাধ্যমে আল্লাহর কালাম (কুরআন) প্রচারের ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে বিবেচিত হয়।

বৌদ্ধ ধর্মে 'মৈত্রেয়' বুদ্ধ: শান্তির দূত মুহাম্মদ (সা.)

বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থ 'দিঘা-নিকায়া'য় এক ভবিষ্যৎ বুদ্ধের আগমনের কথা বলা হয়েছে, যার নাম 'মৈত্রেয়'—অর্থাৎ শান্তি ও করুণার বুদ্ধ। যখন শিষ্য আনন্দ গৌতম বুদ্ধকে জিজ্ঞাসা করেন, তাঁর মৃত্যুর পর কে তাদের উপদেশ দেবেন, তখন বুদ্ধ বলেন, তিনিই একমাত্র বা শেষ বুদ্ধ নন। যথাসময়ে আরও একজন বুদ্ধ আসবেন, যিনি তাঁর চেয়েও পবিত্র ও অধিকতর আলোকপ্রাপ্ত হবেন এবং একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মমত প্রচার করবেন। এই 'মৈত্রেয়' যে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-ই, তা তাঁর 'রাহমাতুল্লিল আলামিন' (সমগ্র বিশ্বের জন্য করুণা ও রহমত স্বরূপ) বিশেষণের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

পার্শী ধর্মশাস্ত্রে 'আহম্মদ': নৈতিক জাগরণের দূত

পার্শী জাতির ধর্মগ্রন্থ 'জিন্দাবেস্তা' ও 'দসাতির'-এ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মিলাদের অর্থাৎ আগমনের সুস্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে, এমনকি তাঁর 'আহম্মদ' নামটিও উল্লেখ আছে। জিন্দাবেস্তায় বলা হয়েছে: "আমি ঘোষণা করছি, হে স্পিতাম জরথুষ্ট্রু, পবিত্র আহম্মদ (ন্যায়বানদিগের আশীর্বাদী) নিশ্চয় আসবেন, যার কাছ থেকে তোমরা সৎ চিন্তা, সৎ বাক্য, সৎ কাজ এবং বিশুদ্ধ ধর্ম লাভ করবে।"

'দসাতির' গ্রন্থে আরও এক আকর্ষণীয় ভবিষ্যদ্বাণী আছে। এতে বলা হয়েছে, যখন পার্শীরা তাদের ধর্ম ভুলে গিয়ে নৈতিক অধঃপতনের চরম সীমায় পৌঁছাবে, তখন আরবদেশে একজন মহাপুরুষের জন্ম হবে। তাঁর শিষ্যরা পারস্যদেশ ও পারসিক জাতিকে পরাজিত করবে, তাদের মন্দিরে অগ্নিপূজা করবে না, বরং ইব্রাহিমের কাবা ঘরের দিকে মুখ করে প্রার্থনা করবে। সেই মহাপুরুষের শিষ্যরা বিশ্ববাসীর জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হবে। এই বর্ণনাগুলো হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর সাহাবীদের হাতে পারস্য বিজয়ের ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে মিলে যায়।

হিন্দু ধর্মে 'অন্তিম অবতার': কল্কি রূপে মুহাম্মদ (সা.)

হিন্দু ধর্মশাস্ত্র, বিশেষ করে বেদ ও পুরাণসমূহে এক অন্তিম অবতারের আগমনের কথা বলা হয়েছে, যার বর্ণনা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের সাথে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়।

ঈশ্বরের একত্ববাদ:

হিন্দু ধর্মের উপনিষদ (ছন্দোগ্য, অথর্ববেদ, ঋগবেদ কট-উপনিষদ) এবং ঋগবেদের বিভিন্ন মন্ত্রে ঈশ্বরের একত্ববাদের সুস্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে। যেমন: "একম এব অদ্বিতীয়ম্" (ঈশ্বর বা প্রভু এক ও অদ্বিতীয়), "সা এশা এ-কা, এ-কা ভির দি-কা- এহ" (তিনি একজনই, দ্বিতীয় বলতে কিছুই নেই), "একং ব্রক্ষ্ম দ্বিতীয়ং নাস্তি নেহ্, নাহ নাস্তি কিন্চন" (পরমইশ্বর এক, তিনি ব্যতীত কেহই নেই)। ঋগবেদে আরও আছে: "একম সাদবে পুরাবা হুদা ওয়াদান্তে" (সত্য খোদা একজনই, তবে বিভিন্ন সময় মানুষ তাকে বিভিন্ন নামে ডেকেছে)। এটি ইসলামের তওহীদ বা একত্ববাদের ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

ভবিষ্য পুরাণে শেষ নবীর আগমন:

হিন্দু ধর্মগ্রন্থের স্মৃতি অংশের 'ভবিষ্য পুরাণ' ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলে। এর তৃতীয় পর্ব, তৃতীয় খন্ড, তৃতীয় অধ্যায়ের ৫ থেকে ৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: "মরুভূমি থেকে একজন ম্রিচ্য তার সঙ্গীদেরকে সাথে নিয়ে আসবেন তার নাম হবে মোহাম্মদ সা."। 'ম্রিচ্য' অর্থ বিদেশি এবং 'মনস্থল' অর্থ বালুময় মরুভূমি। রাজা ভূত তাকে স্বাগত জানাবেন সম্মানের সাথে এবং বলবেন: "হে মানবজাতি গর্ব! আপনি শয়তানকে হারানোর জন্য এক বিশাল বাহিনী তৈরি করেছেন।"

কল্কি অবতার: মুহাম্মদ (সা.)-এর বিস্তারিত বর্ণনা:

হিন্দু ধর্মে 'রসূল' কে 'অবতার' বলা হয় এবং কলিযুগের শেষ অবতারকে 'কল্কি অবতার' বলা হয়। কল্কি পুরাণে এই অন্তিম অবতারের নাম, পিতার নাম, মাতার নাম এবং জন্মস্থান সম্পর্কে যে বর্ণনা রয়েছে, তা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের বিস্তারিত তথ্যের সাথে হুবহু মিলে যায়:

অন্তিম অবতারের নাম: 'নরাশংস' (সংস্কৃত 'প্রশংসিত ব্যক্তি', যার আরবি প্রতিশব্দ 'মুহাম্মদ')

অন্তিম অবতারের পিতার নাম: 'বিষ্ণুযশা' (সংস্কৃত 'মালিকের দাস', যার আরবি প্রতিশব্দ 'আবদুল্লাহ')

অন্তিম অবতারের মাতার নাম: 'সুমতি' (সংস্কৃত 'নিরাপদ-শান্তি', যার আরবি প্রতিশব্দ 'আমেনা')

অন্তিম অবতারের জন্মস্থান: 'শম্ভল' (সংস্কৃত 'শান্তির স্থান', যার আরবি প্রতিশব্দ 'বালাদুল আমিন' বা মক্কা মুকাররমা)

ঐতিহাসিকদের মতে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২০ এপ্রিল সোমবার দিবাগত রাতে মক্কার বালাদুল আমিনে পিতা আবদুল্লাহ ও মাতা আমেনার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন।

বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের এই অবিচ্ছিন্ন ভবিষ্যদ্বাণীগুলো প্রমাণ করে যে, হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমন কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না, বরং তা ছিল সুপরিকল্পিত এবং পূর্বঘোষিত। এই প্রমাণগুলো মানবজাতির জন্য তাঁর বিশ্বজনীনতার এক শক্তিশালী সাক্ষ্য বহন করে এবং বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সংলাপ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

আল-আমিন ইসলাম/

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ