ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫ আশ্বিন ১৪৩২

Alamin Islam

Senior Reporter

বিনিয়োগকারীদের জন্য সতর্কবার্তা: ৩,০০০ সদস্যের প্রতারক চক্রের চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস

শেয়ারনিউজ ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ সেপ্টেম্বর ৩০ ২৩:৪৫:৪০
বিনিয়োগকারীদের জন্য সতর্কবার্তা: ৩,০০০ সদস্যের প্রতারক চক্রের চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এক বিশাল প্রতারণার জাল উন্মোচন করেছে ডিসমিসল্যাব-এর মাসব্যাপী এক বিস্তারিত অনুসন্ধান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ব্যবহার করে প্রতারকরা কীভাবে নিরীহ বিনিয়োগকারীদের ফাঁদে ফেলছে, তার চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এই প্রতারক চক্র ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে উচ্চ রিটার্নের মিথ্যা লোভ দেখিয়ে হাজার হাজার মানুষকে তাদের ভুয়া বিনিয়োগ প্রকল্পে টানছে।

প্রতারণার কৌশল: সরল, তবুও কার্যকর

ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতারকদের কৌশল অত্যন্ত সরল হলেও এর কার্যকারিতা অভাবনীয়। প্রথমে তারা ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দেয়, যেখানে দ্রুত এবং অবিশ্বাস্য রকম উচ্চ বিনিয়োগ রিটার্নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যোগ দিতে উৎসাহিত করা হয়।

একবার হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হওয়ার পর, ভুয়া বিশেষজ্ঞরা সেখানে বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস অর্জন করে। তাদের কথা এতটাই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় যে, বেশিরভাগ বিনিয়োগকারীই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। এরপর বিনিয়োগকারীদের একটি ভুয়া ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করতে বলা হয় এবং বিকাশ বা ক্যাশ-এর মতো এমএফএস প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে অর্থ বিনিয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়।

৩,০০০ সদস্যের ভুয়া গ্রুপের জট

অনুসন্ধানী দলটি নিজেদের সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রতারকদের একাধিক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে প্রবেশ করে পুরো প্রক্রিয়াটি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। অনুসন্ধানে সিটি ব্রোকারেজ লিমিটেড এবং ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ-এর মতো সুপরিচিত ব্রোকারেজ সংস্থার নাম ব্যবহার করা অন্তত ২০টি সক্রিয় গ্রুপ খুঁজে পাওয়া গেছে।

এই গ্রুপগুলোর সম্মিলিত সদস্য সংখ্যা ৩,০০০ ছাড়িয়ে গেছে, যা প্রতারণার ব্যাপকতা নির্দেশ করে। ডিসমিসল্যাব-এর তথ্যমতে, কেবল গত সেপ্টেম্বর মাসেই কমপক্ষে ১৫টি ফেসবুক পেজ থেকে শত শত বিজ্ঞাপন চালানো হয়েছিল এসব গ্রুপে সদস্য সংগ্রহের জন্য। প্রতিটি গ্রুপই এমনভাবে সাজানো, যেন বিনিয়োগকারীরা এটিকে একটি বৈধ এবং নিরাপদ লেনদেন প্রক্রিয়া বলে মনে করেন।

ভুয়া অ্যাপ, নকল ওয়েবসাইট ও ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে লেনদেন

প্রতারকরা তাদের প্রতারণাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে আসল ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানের নাম ও লোগো ব্যবহার করে নকল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে। যেমন: সিটি ব্রোকারেজ লিমিটেড-এর নামে তৈরি গ্রুপে ভুয়া একটি অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ ডাউনলোড করতে বলা হয়, যা দেখতে সম্পূর্ণ আসল ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মের মতো। একইভাবে, ব্র্যাকের নামে তৈরি গ্রুপে আসল সংস্থার ব্র্যান্ডিং নকল করা একটি ভুয়া ওয়েবসাইটে ইউজারদের পাঠানো হতো।

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো, বিনিয়োগকারীদের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্রোকারেজ চ্যানেলে টাকা না পাঠিয়ে, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) বা ব্যাংকের মাধ্যমে সরাসরি প্রতারকদের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে টাকা স্থানান্তর করতে বাধ্য করা হয়। এর ফলে বিনিয়োগকারীদের অর্থ সুরক্ষিত থাকার কোনো সম্ভাবনা থাকে না এবং ক্ষতির শিকার হলে তা উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

প্রতারকরা তাদের প্রচারণার বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন-এর মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নাম ও ছবিও ব্যবহার করেছে, যা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আরও বেশি বিভ্রান্ত করছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার সতর্কবার্তা ও মামলার প্রস্তুতি

এই কেলেঙ্কারির শিকার হওয়া ব্রোকারেজ সংস্থাগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)-কে এই প্রতারণা সম্পর্কে সতর্ক করেছে।

আগে থেকেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং বিএসইসি একই ধরনের প্রতারক চক্র সম্পর্কে সতর্কবার্তা জারি করেছিল। ডিএসই স্পষ্টভাবে জানিয়েছিল, প্রতারকরা ডিএসই-এর নাম, লোগো এবং অফিসিয়াল ঠিকানা ব্যবহার করে বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করছে।

এদিকে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি বিনিয়োগকারীদের আবারও মনে করিয়ে দিয়েছে যে, নিবন্ধন ছাড়াই শেয়ারবাজার সংক্রান্ত পরামর্শ প্রকাশ করা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (রিসার্চ অ্যানালিস্ট) রুলস, ২০১৩ অনুযায়ী সম্পূর্ণ অবৈধ।

বিনিয়োগকারীদের কোনো প্রকার প্রলোভনে না পড়ে সতর্ক থাকার এবং যেকোনো বিনিয়োগের আগে প্রতিষ্ঠানের বৈধতা যাচাই করার জন্য বিএসইসি আহ্বান জানিয়েছে। এই প্রতারণা চক্রের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।

আল-মামুন/

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ