ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২

MD Zamirul Islam

Senior Reporter

বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠিন সিদ্ধান্ত: ৯ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ! আমানতকারীদের কি হবে

অর্থনীতি ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ অক্টোবর ১৪ ১২:২৬:৫১
বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠিন সিদ্ধান্ত: ৯ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ! আমানতকারীদের কি হবে

দেশের আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দীর্ঘদিনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে না পারার কারণে প্রাথমিকভাবে ৯টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ব্যাপক লুটপাট ও আর্থিক দুর্নীতির শিকার হয়েছিল। এই সিদ্ধান্তের ফলে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত আমানত ঝুঁকির মুখে পড়েছে, এবং সরকারের ৯ হাজার কোটি টাকা লোকসানের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কেন এই কঠোর সিদ্ধান্ত?

বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে উঠে এসেছে, ব্যাংকবহির্ভূত এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে অক্ষম। উচ্চ খেলাপি ঋণ, ভয়াবহ মূলধন ঘাটতি এবং লাগামহীন অনিয়ম-দুর্নীতিই এর মূল কারণ। শুধু ব্যক্তি আমানত নয়, দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বড় অঙ্কের প্রাতিষ্ঠানিক আমানতও আটকা পড়েছে।

আমানত আটকে থাকার চিত্র:

ব্যাংকিং খাত: একীভূত হতে যাওয়া ৫টি দুর্বল ব্যাংকের কাছে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকার স্থায়ী আমানত (এফডিআর) আটকে আছে।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক: ১০ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা

ইউনিয়ন ব্যাংক: ৮ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা

এক্সিম ব্যাংক: ৮ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা

সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক: ৫ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক: ৪ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা

পদ্মা ব্যাংকসহ অন্যান্য দুর্বল ব্যাংকের কাছেও বিপুল অঙ্কের আমানত আটকে আছে।

এনবিএফআই খাত: ২০টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি প্রাতিষ্ঠানিক এফডিআর আটকে আছে। এর মধ্যে চরম ঝুঁকিপূর্ণ ৯টি প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বন্ধের তালিকায় থাকা ৯টি প্রতিষ্ঠানের করুণ দশা:

আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে না পারা, আকাশচুম্বী খেলাপি ঋণ এবং বড় অঙ্কের মূলধন ঘাটতি—এই তিনটি প্রধান সূচকের ভিত্তিতে চিহ্নিত করা হয়েছে এই ৯টি প্রতিষ্ঠানকে:

এফএএস ফাইন্যান্স: মোট ঋণের ৯৯.৯৩% খেলাপি (১৮১৪ কোটি টাকা); ক্রমপুঞ্জীভূত লোকসান ১৭১৯ কোটি টাকা।

ফারইস্ট ফাইন্যান্স: ৯৮% ঋণখেলাপি; লোকসান ১০১৭ কোটি টাকা।

বিআইএফসি: ৯৭.৩০% ঋণখেলাপি; লোকসান ১৪৮০ কোটি টাকা।

ইন্টারন্যাশনাল লিজিং: ৩৯৭৫ কোটি টাকা ঋণের ৯৬% খেলাপি; ক্রমপুঞ্জীভূত লোকসান ৪২১৯ কোটি টাকা।

পিপলস লিজিং: ৯৫% খেলাপি; লোকসান ৪৬২৮ কোটি টাকা।

আভিভা ফাইন্যান্স: ২৪৩০ কোটি টাকা বা ৮৩% খেলাপি; লোকসান ৩৮০৩ কোটি টাকা।

প্রিমিয়ার লিজিং: ৯৮৪ কোটি টাকা বা ৭৫% খেলাপি; লোকসান ৯৪১ কোটি টাকা।

জিএসপি ফাইন্যান্স: ৫১৫ কোটি টাকা বা ৫৯% খেলাপি; লোকসান ৩৩৯ কোটি টাকা।

প্রাইম ফাইন্যান্স: ৫৩৪ কোটি টাকা বা ৭৮% ঋণখেলাপি; ক্রমপুঞ্জীভূত লোকসান ৩৫১ কোটি টাকা।

বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ:

সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শফিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, "এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। শুধু কমিশন বাণিজ্য নয়, উচ্চ সুদের প্রলোভনের পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান ব্যক্তিরাও এফডিআর পেতে প্রভাব বিস্তার করতেন। বিশেষ করে তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও এস আলমের প্রভাব বিস্তারের কথা সবাই জানে।"

খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, রাজনৈতিক প্রভাব, কমিশন বাণিজ্য এবং উচ্চ সুদের লোভে দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এফডিআর রাখা হয়, যা এখন "গলার কাঁটা" হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ না হলে এমন পরিস্থিতি চলতেই থাকবে। কেউ কেউ এফডিআর রাখার ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের ওপর জোর দিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান যুগান্তরকে জানিয়েছেন, "কোন প্রতিষ্ঠান কোথায় টাকা রাখবে, সেটা তাদের নিজস্ব বিজনেস পলিসি। এখানে নীতিমালার চেয়ে মূল সমস্যা দুর্নীতি। দুর্নীতি বন্ধ না হলে এসব সমস্যার সমাধান হবে না।"

এই কঠোর পদক্ষেপ আর্থিক খাতে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে আমানতকারীদের টাকা ফেরত আনা এবং আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। `

তানভির ইসলাম/

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ