ঢাকা, শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৫, ৯ কার্তিক ১৪৩২

Alamin Islam

Senior Reporter

যে এক আসনে জিতলে বিজয়ী প্রার্থীর দল সরকার গঠন করে

রাজনীতি ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ অক্টোবর ২৪ ১৪:৪৪:৪৮
যে এক আসনে জিতলে বিজয়ী প্রার্থীর দল সরকার গঠন করে

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসনটি একটি সুপ্রচলিত ধারণার কারণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ—এই আসনে যে রাজনৈতিক দল জয়ী হয়, তারাই পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার ভার গ্রহণ করে। নির্বাচনী উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনেই এই প্রথাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মর্যাদাপূর্ণ এই আসন থেকে অতীতে বিজয়ীরা সরকারের অভ্যন্তরেও গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী এই আসন থেকে জয়লাভ করে জাতীয় সংসদের স্পিকারের পদে ভূষিত হয়েছিলেন।

এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন প্রতিটি দলের প্রভাবশালী প্রার্থীরা এবং বিজয়ী প্রার্থীর জন্য সাধারণত একটি বড় রাষ্ট্রীয় পদ নিশ্চিত হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর চেয়ারপারসনের দুই উপদেষ্টা, সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী এবং খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির, এই আসনের প্রার্থী হিসেবে বিবেচ্য হচ্ছেন।

সিলেট-১: পুরোনো দ্বন্দ্বে আরিফুল-মুক্তাদির মুখোমুখি

সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত সাইফুর রহমানের একান্ত সহচর ছিলেন আরিফুল হক চৌধুরী। অন্যদিকে, খন্দকার মুক্তাদির হলেন সিলেট বিএনপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রয়াত সংসদ সদস্য খন্দকার আব্দুল মালিকের পুত্র। প্রায় তিন দশক আগের সাইফুর-খন্দকার দ্বন্দ্বের উত্তরাধিকার বহন করে আরিফুল ও মুক্তাদির বর্তমানে সিলেট বিএনপির দুটি প্রধান বলয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

সম্প্রতি মুক্তাদির আমেরিকা সফরে থাকার সুযোগে আরিফুল হক চৌধুরী মাঠের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তিনি ঢাকায় মহাসচিবের সাথে বৈঠক শেষে বুধবার এক বিশাল জনসমাবেশ করে সিলেট-১ আসনে নিজের প্রার্থিতা ঘোষণা করেন। একই দিনে মুক্তাদিরও নিউইয়র্কের প্রবাসীদের এক মতবিনিময় সভা থেকে একই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা জানান, তার দু-একদিনের মধ্যেই দেশে ফেরার কথা রয়েছে। উল্লেখযোগ্য, এর আগে আরিফুল লন্ডন সফর করেন এবং দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বৈঠকে তাকে সিলেট-৪ আসনের তালিকায় ডাকা হলে তিনি আপত্তি জানিয়ে সিলেট-১ অথবা মেয়র পদে নির্বাচনের দাবি জানান।

এদিকে, এই আসনে তাদের পূর্বঘোষিত প্রার্থী পরিবর্তন করেছে জামায়াতে ইসলামী। সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়েরকে নির্বাচন মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দিয়ে সিলেট-৬ আসন থেকে সরিয়ে জেলা আমির মাওলানা হাবিবুর রহমানকে সিলেট-১ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

সিলেট-২: ইলিয়াসের প্রভাব ও হুমায়ুন কবিরের পদোন্নতি

এখনও 'ইলিয়াস আলীর আসন' হিসেবেই পরিচিত সিলেট-২। সাবেক এই বিএনপি নেতা নিখোঁজ থাকার পরও আসনটিতে দলীয় মনোনয়ন ঘিরে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। প্রার্থী পরিবর্তনের ইঙ্গিত এখন অনেকটা স্পষ্ট। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা পদ থেকে হুমায়ুন কবিরকে যুগ্ম মহাসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, প্রয়াত হারিছ চৌধুরী দীর্ঘকাল এই পদটি অলঙ্কৃত করে রেখেছিলেন। ইলিয়াসের স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর স্থানীয়ভাবে বেশ গ্রহণযোগ্য। ইলিয়াসের জনপ্রিয়তার কারণে এই আসনে অন্য প্রার্থীরা তেমন সুবিধা করতে পারবেন না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। আসনটি অতীতে দুইবার শরিক দলকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, এবং তারাও বিজয়ী হয়েছিলেন।

সিলেট-৩ ও ৪: তীব্র জনজোয়ার ও জামায়াতের ‘ভীতি’

সিলেট-৩ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী, যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেক এবং ব্যারিস্টার এম এ সালাম দলীয় মনোনয়ন নিয়ে একে অপরের প্রতিপক্ষ। কাইয়ুম তৃণমূল পর্যায়ে অত্যন্ত জনপ্রিয়, মালেক প্রবাসী ভোটারদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা সম্পন্ন, আর সালাম কেন্দ্রীয় পর্যায়ে খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা হিসাবে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন। এই আসনে আরও যারা প্রার্থী হতে চান তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক তুখোড় ছাত্রনেতা ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক আব্দুল আহাদ খান জামাল, জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এম এ হকের পুত্র ব্যারিস্টার রিয়াসাদ আজিম আদনান এবং যুক্তরাজ্য বিএনপিনেতা ড. মোহাম্মদ ফয়েজ উদ্দিন এমবিই। জামায়াত এখানে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাওলানা লোকমান আহমদকে প্রার্থী করেছে, আর এনসিপি থেকে ব্যারিস্টার নুরুল হুদা জুনেদ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

সিলেট-৪ আসনে বিএনপির হুড়োহুড়ি সবচেয়ে বেশি। মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকের পর আরিফুল হক চৌধুরীর এই আসনে প্রার্থিতার একটি গুঞ্জন শোনা গেলেও, তিনি নিজেই স্পষ্ট করে জানিয়েছেন যে তিনি সিলেট-১ আসনেই নির্বাচন করতে আগ্রহী। ফলে এই আসনে সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকী, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান হাকিম চৌধুরী, মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম, বিএনপি থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নেওয়া বহুল আলোচিত নেতা অ্যাডভোকেট শামসুজ্জামান জামান, সাবেক এমপি দিলদার হোসেন সেলিমের সহধর্মিণী অ্যাডভোকেট জেবুন্নাহার সেলিম এবং ব্যারিস্টার কামরুজ্জামান সেলিম মনোনয়নের জন্য লড়ছেন। এই আসনে জামায়াতের একক প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন। বিএনপির এত প্রার্থীর ভিড়ে ভোটের মাঠে জামায়াতের জয়নালের উপস্থিতি অনেকটা ভীতি সৃষ্টি করেছে।

সিলেট-৫ ও ৬: ইসলামপন্থিদের ঘাঁটি ও 'চৌধুরী' আধিপত্য

সিলেট-৫ আসনে বিএনপির মনোনয়ন যুদ্ধে আছেন চাকসুর সাবেক নেতা মামুনুর রশীদ মামুন, প্রয়াত হারিছ চৌধুরীর ভাই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী, সাবেক ছাত্রনেতা সিদ্দিকুর রহমান পাপলু, সংযুক্ত আরব আমিরাত বিএনপির আহ্বায়ক জাকির হোসেন এবং হারিছ চৌধুরীর মেয়ে সামিরা তানজীন চৌধুরী। জামায়াতে ইসলামী হাফিজ মাওলানা আনোয়ার হোসেন খানকে প্রার্থী করলেও এই আসনটি মূলত জামায়াতবিরোধী ইসলামপন্থি দলগুলোর কেন্দ্র। তাই এখানে জমিয়তের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুক একজন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। এই অঞ্চলের ভোটারদের ওপর ফুলতলীর পীরের অনুসারীদের প্রভাব বেশি। গুঞ্জন রয়েছে, বিএনপি শেষ মুহূর্তে এই আসনটি জমিয়তকে ছেড়ে দিতে পারে।

সিলেট-৬ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের একটি বড় অংশ চৌধুরী বংশের সদস্য। কেন্দ্রীয় নেতা আবুল কাহের শামীম, ফয়সল আহমদ চৌধুরী, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমেদ চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. এনামুল হক চৌধুরী, সাবেক এমপি ড. সৈয়দ মকবুল হোসেনের মেয়ে সৈয়দা আদিবা হোসেন, যুক্তরাজ্য বিএনপির সাবেক সভাপতি সাবিনা খান পপি এবং চিত্রনায়ক হেলাল খান এই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী। সম্প্রতি জামায়াতের পক্ষ থেকে মাওলানা হাবিবুর রহমানের পরিবর্তে ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির সেলিম উদ্দিনকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

বিএনপির কৌশল: জোট ও একক প্রার্থী

এ বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক মেয়র জি কে গউছ জানান, সিলেটের মোট ১৯টি আসনেই এককভাবে ধানের শীষের প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য বিএনপি প্রস্তুত। তিনি আরও যোগ করেন যে, কোনো জোটসঙ্গীকে ছাড় দেওয়ার বিষয়ে হাইকমান্ড থেকে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা আসেনি। তবে, জোট গঠনের প্রক্রিয়া ও আসন বণ্টনের বিষয়ে দলের শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনা চলমান রয়েছে। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে দলের বৃহত্তর স্বার্থে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে মাঠের নেতারা প্রস্তুত।

তানভির ইসলাম/

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ