Alamin Islam
Senior Reporter
earthquake now-ভূমিকম্প: চরম ঝুঁকিতে রাজধানী ঢাকা, বিশেষজ্ঞদের জরুরি বার্তা
গত শুক্রবার (নভেম্বর ২১) রাতে রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রার ভূকম্পনটি ঢাকার ভঙ্গুর কাঠামোর উপর একটি স্পষ্ট বিপদ সংকেত হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে বিস্তৃত এই মহানগরী একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পের আঘাত প্রতিহত করার মতো অবস্থায় নেই এবং এক বিশাল বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। জাতীয় নির্মাণ বিধিমালার তোয়াক্কা না করে গড়ে ওঠা স্থাপনাগুলোর কারণে বড় ধরনের ধাক্কার আশঙ্কা করছেন তারা। এই পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
ভয়াবহ চিত্র: ২১ লাখের মধ্যে কয়েক লাখই ধ্বংসের ঝুঁকিতে
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) 'আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট'-এর অধীনে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় ঢাকা শহরের ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ চিত্র উঠে এসেছে। এই জরিপ অনুযায়ী, রাজধানীতে মোট ২১ লাখ ৪৫ হাজার ভবন রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা— ঢাকার সন্নিকটে মধুপুর ফল্টে (টাঙ্গাইল) ৬.৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানলে ঢাকার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার কয়েক লাখ ভবন ধসে পড়তে পারে। এর প্রধান কারণ, স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে জাতীয় ভবন নির্মাণ কোড যথাযথভাবে অনুসরণ না করা।
সমীক্ষায় আরও দেখা যায়, বেশিরভাগ ভবন নির্মাণে সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে প্রায় ৯৫ ভাগ ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। নগর পরিকল্পনাবিদদের তথ্যমতে, ২০০৬ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৯৫ হাজার নতুন স্থাপনা নির্মাণ হলেও রাজউক থেকে মাত্র ৪ হাজার ১৪৭টি নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ, প্রায় ৯৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ স্থাপনা অনুমোদন ছাড়াই তৈরি হয়েছে। এ কারণেই বড় কম্পনের মুখে রাজধানী এক ভয়াবহ সংকটে পড়বে।
ঝুঁকি বাড়ার নেপথ্যের কারণ ও মাটির দুর্বলতা
বিশেষজ্ঞরা এই উচ্চ ঝুঁকির পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এ শহরে অপরিকল্পিতভাবে বহুতল ভবন, ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি এবং অত্যন্ত সরু রাস্তাগুলো অন্যতম উদ্বেগের বিষয়। অনেক স্থাপনা ভূমিকম্প সুরক্ষা মানদণ্ড মেনে তৈরি না হওয়ায়, এগুলো 'মৃত্যুফাঁদে' পরিণত হয়েছে।
ঝুঁকির একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো বাংলাদেশের মাটির গঠনগত দুর্বলতা। দেশের বৃহৎ অংশই আলগা ও জলাবদ্ধ পলিমাটির ওপর স্থাপিত। শক্তিশালী কম্পনের সময় এই মাটি তরলীকৃত (Liquefaction) হয়ে যেতে পারে, যা ভবন ধসের বড় কারণ। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ভবনগুলোর ওপর পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, অনেক পুরাতন (২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী) ভবনে রড-সিমেন্টের মান নিয়ন্ত্রণ বা নকশা অনুসরণ করা হয়নি। সামান্য কম্পনও এসব স্থাপনার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
কম্পনের প্রাথমিক ধাক্কা: ক্ষতিগ্রস্ত ১৪ স্থাপনা
গত শুক্রবারের ৫.৭ মাত্রার ভূকম্পনটি ঢাকায় ১৪টি ভবনের ক্ষতি করেছে। ঢাকা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসার মো. সালাহ উদ্দীন-আল-ওয়াদুদ জানান, ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ভবনগুলোর মধ্যে মালিবাগ চৌধুরী পাড়া, আরমানিটোলা, সূত্রাপুরের স্বামীবাগ, বনানী, কলাবাগান, বসুন্ধরা, নর্দ্দা, দক্ষিণ বনশ্রী, মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও (২টি), বাড্ডা, মগবাজারের মধুবাগ এবং হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকার একটি করে স্থাপনা রয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী সতর্ক করে বলেন, এই ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পটি বৃহত্তর আঘাতের আগে ছোট ছোট ভূকম্পনেরই ইঙ্গিত। যদি ঢাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে, বহু স্থাপনা ভেঙে যাবে এবং প্রচুর প্রাণহানি ঘটবে।
রাজউকের দুর্বলতা ও খোলা জায়গার অভাব
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, এই ভূমিকম্প বার্তা দিচ্ছে যে একটি বড় আকারের ভূমিকম্প আসন্ন, যা আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বলছিলাম। তিনি উল্লেখ করেন, ভূমিকম্পের মতো বড় দুর্যোগ মোকাবিলায় ঢাকা শহরে জনসাধারণের আশ্রয় নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ ও খোলা জায়গার চরম ঘাটতি রয়েছে।
নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছে পর্যাপ্ত জনবল ও যন্ত্রপাতি নেই যা দিয়ে ভবনগুলো ভূমিকম্প সহনশীল কি না, তা নির্ণয় করা যায়। তাদের কাছে অনুমোদনহীন ভবনের সঠিক সংখ্যাও নেই, এমনকি খাল-বিল নদী দখল করে নির্মিত ভবনের সংখ্যাও অজানা।
ড. আদিল মুহাম্মদ খান আরও বলেন, ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি, ২০২০), ঢাকা মহানগরীর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮, ড্যাপসহ একাধিক নীতি ও বিধান বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি, দুর্বল তত্ত্বাবধান ও জবাবদিহির অভাব পরিস্থিতিকে অকার্যকর করে তুলেছে।
আইনগত পদক্ষেপ ও রাজউকের খসড়া নীতিমালা
অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিতকরণে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) সক্রিয় হয়েছে। চলতি বছর তারা প্রায় সাড়ে ৩ হাজার অবৈধ ভবন চিহ্নিত করেছে এবং এসবের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। তাছাড়া বসিলা, ঢাকা উদ্যান ও কেরানীগঞ্জসহ আশপাশের এলাকায় শত শত ভবন গড়ে উঠেছে কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম জানিয়েছেন, বিধিবহির্ভূত ৩ হাজার ৩৮২টি ভবন চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শুক্রবারের ভূকম্পনের পর ফাটল দেখা দেওয়া ভবনগুলো চিহ্নিত করতে এলাকাভিত্তিক কর্মকর্তাদের মাঠে নামানো হয়েছে।
এদিকে, নকশাবিহীন স্থাপনাগুলো নিয়ে রাজউক একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করেছে। এই নীতিমালায় প্রস্তাব করা হয়েছে, যেসব ভবন ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ও অন্যান্য বিধিমালা অনুসরণ করে নির্মিত হয়েছে, সেগুলো বিদ্যমান নকশা অনুমোদন ফি'র তিন থেকে পাঁচ গুণ জরিমানা দিয়ে বৈধতা পেতে পারে। তবে, যেসব স্থাপনা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ড্যাপের সংশোধন ও নতুন বিধিমালা
রাজউক ২০২২ সালে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) গেজেট আকারে প্রকাশ করেছিল। সম্প্রতি সরকার এই ড্যাপ সংশোধনের প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে। সংশোধিত ড্যাপে ঢাকাকে আগের ২৭৫টির বদলে ৬৮টি ব্লকে বিভক্ত করা হয়েছে এবং এর আয়তন এক হাজার ৯৪ বর্গকিলোমিটারে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায়, যেখানে আগে পাঁচতলা ভবন নির্মাণের অনুমতি মিলত, সেখানে এখন ১০ থেকে ১১ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণ করা যাবে। নতুন শর্তে প্লটে যত বেশি খোলা জায়গা রাখা হবে, উচ্চতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে তত অতিরিক্ত ছাড় দেওয়া হবে।
খসড়া ‘ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা-২০২৫’ অনুযায়ী, অকুপ্যান্সি সার্টিফিকেট একবার নিলে তা আজীবনের জন্য কার্যকর থাকবে। পাঁচ কাঠা বা তার বেশি জমির প্লটে স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি) স্থাপন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ: মানবিক বিপর্যয় এড়াতে করণীয়
নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান পরামর্শ দিয়েছেন, ভূমিকম্প ঠেকানো সম্ভব না হলেও ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করা সম্ভব। তিনি জরুরি ভিত্তিতে কঠোরভাবে ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড ও নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করতে বলেন।
তার সুপারিশগুলো হলো:
'বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি (বিবিআরএ)' গঠন করে দ্রুত বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
নিম্নাঞ্চলে নির্মাণ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা।
জলাধার, বেসিন এলাকা বা জলবিভাজিকা স্থান ভরাট করে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন না করা।
পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর তালিকা অবিলম্বে প্রকাশ এবং সেগুলো অপসারণের পদক্ষেপ নেওয়া।
রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত সব বিপজ্জনক ভবন দ্রুত খালি করা।
উল্লেখ্য, ঢাকার কাছাকাছি নরসিংদীর মাধবদীতেই সবশেষ শুক্রবার আঘাত হানা ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল। এছাড়াও, ১৫-২০ বছরের মধ্যে নারায়ণগঞ্জে ৫.১ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প নথিভুক্ত করা হয়েছিল। অতীতে ১৮২২, ১৯১৮ ও ১৮৮৫ সালে ঢাকার অদূরে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ইতিহাস রয়েছে।
আল-মামুন/
পাঠকের মতামত:
আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ
- বাংলাদেশ বনাম আয়ারল্যান্ড দ্বিতীয় টেস্ট: দ্বিতীয় দিন শেষে চালকের আসনে বাংলাদেশ
- আজকের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল কোথায়
- সতর্কবার্তা: ‘আরও বড় ভূমিকম্প হতে পারে’
- ভয়াবহ ভূমিকম্পে ঢাকাসহ কেঁপে উঠল সারাদেশ
- বিএনপি অভ্যন্তরীণ কোন্দল: যেসব আসনে পরিবর্তন হচ্ছে প্রার্থী
- বাংলাদেশ বনাম ভারত সেমি ফাইনাল: সুপার ওভারে শেষ ম্যাচ, জানুন ফলাফল
- সোনার দামে বড় পতন: ২২ ক্যারেট স্বর্ণের ভরি এখন কত
- আসছে বড় ভূমিকম্প: মহাবিপদের আগাম সতর্কতা দিল আবহাওয়া অফিস
- আজকের সোনার দাম:(শুক্রবার, ২১ নভেম্বর ২০২৫)
- ভূমিকম্পে কাঁপল দেশ; আতঙ্কের মাঝেই গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিলেন আজহারী
- dhaka division earthquake:‘এটি বড় ভূমিকম্পের আগাম বার্তা’
- ভূমিকম্পে কাঁপলো দেশ: ১৩টি এলাকা সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে
- ভূমিকম্প: এই সময় করণীয় কি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
- বাংলাদেশ বনাম ভারত সেমি ফাইনাল: খেলাটি সরাসরি দেখুন Live
- আজ ব্রাজিল বনাম মরক্কো কোয়ার্টার ফাইনাল: খেলাটি সরাসরি Live দেখবেন যেভাবে