ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ আগস্ট ২০২৫, ২১ শ্রাবণ ১৪৩২

ব্যালট বাক্স এখন মুঠোফোনে: গণতন্ত্রের জন্য একটি ডিজিটাল শপথের সময় এসেছে

রাজনীতি ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ আগস্ট ০৫ ২০:০০:৪৫
ব্যালট বাক্স এখন মুঠোফোনে: গণতন্ত্রের জন্য একটি ডিজিটাল শপথের সময় এসেছে

জুলাইয়ের গণজাগরণ আমাদের একটি রক্তাক্ত কিন্তু স্পষ্ট বার্তা দিয়ে গেছে—এদেশের মানুষ আর সনাতনী নির্বাচনী সহিংসতা, পেশিশক্তির মহড়া আর কারচুপির দুঃস্বপ্ন বয়ে বেড়াতে চায় না। এক বছর পার হতে চলল, কিন্তু প্রশ্নটি রয়েই গেছে: যে পরিবর্তনের জন্য এত ত্যাগ, সেই সত্যিকারের পরিবর্তন কি এসেছে? উত্তর যদি ‘না’ হয়, তবে সমাধান কোথায়? সমাধান হয়তো আমাদের পকেটে থাকা ছোট্ট যন্ত্রটিতেই লুকিয়ে আছে—স্মার্টফোন।

ভোটকেন্দ্রবিহীন, মোবাইল-ভিত্তিক একটি সুরক্ষিত নির্বাচনী ব্যবস্থা এখন আর কোনো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি নয়, বরং এটি একটি বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা। কল্পনা করুন এমন একটি নির্বাচনের দিনের কথা, যেখানে ভোটারদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার বিড়ম্বনা নেই, কেন্দ্র দখলের আতঙ্ক নেই, কিংবা প্রতিপক্ষের হামলায় রক্তাক্ত হওয়ার ভয় নেই। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামের একজন কৃষক থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো প্রবাসী শ্রমিক—সকলেই নিজের পরিচয় যাচাই করে একটি সুরক্ষিত অ্যাপের মাধ্যমে তার গণতান্ত্রিক রায় দিচ্ছেন।

সমালোচকদের শঙ্কাও অমূলক নয়। তারা প্রশ্ন তোলেন নিরাপত্তা, গোপনীয়তা আর সর্বজনীন অংশগ্রহণের। ডিজিটাল সিস্টেম মানেই হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি—এই ভয় দেখিয়ে একটি যুগান্তকারী সম্ভাবনাকে আমরা কতদিন দূরে ঠেলে রাখব? অথচ এই চ্যালেঞ্জগুলোর বিপরীতেই রয়েছে প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান।

ভোটগ্রহণের দিন কয়েক ঘণ্টার জন্য যদি দেশের আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে বিচ্ছিন্ন করে একটি ‘ডিজিটাল দুর্গ’ তৈরি করা হয়, তবে বিদেশি শক্তির সাইবার আক্রমণের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। দেশের সেরা সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি দল গঠন করা যেতে পারে, যারা সার্বক্ষণিক এই ডিজিটাল দুর্গ পাহারা দেবেন। অনেকেই খরচের প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু একটি জাতীয় নির্বাচনে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন, কোটি কোটি ব্যালট ছাপানো আর সহিংসতা মোকাবিলায় যে হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়, তার তুলনায় একদিনের জন্য এমন একটি নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরির খরচ কি সত্যিই বেশি? এটি তো খরচ নয়, বরং গণতন্ত্রের জন্য সেরা বিনিয়োগ।

অনেকে আবার সহজ সমাধান হিসেবে ইন্টারনেটবিহীন এসএমএস ভোটিংয়ের কথা বলেন। কিন্তু এটি গণতন্ত্রের আত্মার সাথে প্রতারণার শামিল। যেখানে ভোটের গোপনীয়তাই থাকে না, সেখানে গণতন্ত্র থাকে কীভাবে? এসএমএস ভোটিং ব্যবস্থা চালু হলে ভোট কেনা-বেচা এবং রাজনৈতিক প্রতিশোধের এক ভয়ংকর সংস্কৃতি তৈরি হবে, যা গণতন্ত্রকে চূড়ান্তভাবে কবর দেবে।

প্রকৃত সমাধান হলো একটি এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপটেড, ব্লকচেইন-ভিত্তিক অ্যাপ। যেখানে প্রতিটি ভোট একটি ডিজিটাল কোডে রূপান্তরিত হয়ে একটি অপরিবর্তনীয় খতিয়ানে জমা হবে। ভোটার একটি বেনামী রসিদ নম্বর দিয়ে কেবল নিশ্চিত করতে পারবেন যে তার ভোটটি জমা পড়েছে, কিন্তু কে কাকে ভোট দিয়েছে তা থাকবে সম্পূর্ণ গোপন। এই প্রযুক্তি আমাদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের চেয়েও বহুগুণ বেশি নিরাপদ হতে পারে, যদি রাষ্ট্র তা চায়।

আমাদের মনে রাখতে হবে, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে অতীতে যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়। তাই জাতীয় পর্যায়ে প্রয়োগের আগে সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভা নির্বাচনে এর পরীক্ষামূলক বাস্তবায়ন জরুরি। এই পাইলট প্রকল্পের সফলতা জনগণের মনে আস্থা তৈরি করবে।

জুলাইয়ের বিপ্লব আমাদের শিখিয়েছে, পরিবর্তন চাইলে অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়। মোবাইল ভোটিং এখন আর কোনো বিলাসিতা নয়, এটি আমাদের ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে পুনরুজ্জীবিত করার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে। প্রশ্নটি এখন আর প্রযুক্তির সক্ষমতার নয়, প্রশ্নটি আমাদের সম্মিলিত ইচ্ছাশক্তি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার। আমরা কি সেই সাহস দেখাতে প্রস্তুত?

লেখক - মনিরুজ্জামান

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ