ঢাকা, বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ১৪ কার্তিক ১৪৩২

MD Zamirul Islam

Senior Reporter

দেশ ত্যাগের পর প্রথম তিন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার

রাজনীতি ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ অক্টোবর ২৯ ২৩:৪১:৩৮
দেশ ত্যাগের পর প্রথম তিন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর নির্বাসিত জীবন থেকে নীরবতা ভঙ্গ করেছেন। গত বছরের গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সংঘটিত ছাত্র-জনতার প্রাণহানির জন্য ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি তিনি সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

আজ বুধবার আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্স, এএফপি এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক দৈনিক দ্য ইনডিপেনডেন্ট-এ একযোগে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর তিনটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। ই-মেইলের মাধ্যমে নেওয়া এই সাক্ষাৎকারগুলোতে তিনি তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার, আসন্ন নির্বাচন, ট্রাইব্যুনালে বিচার এবং দেশে প্রত্যাবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লিখিত জবাব দিয়েছেন। ক্ষমতাচ্যুতির পর এটাই তাঁর প্রথম প্রকাশ্য মন্তব্য।

সাক্ষাৎকারজুড়ে শেখ হাসিনা একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন—ব্যক্তিগতভাবে কোনো ভুল স্বীকার করেননি এবং কোনো কিছুর জন্য অনুশোচনাও দেখাননি। উল্টো, ছাত্র-জনতা হত্যাকাণ্ডের দায় মাঠপর্যায়ে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর চাপিয়েছেন। এমনকি, তাঁর ভাষায়, এই ‘সহিংস বিদ্রোহ’ দমনকে তিনি একটি ‘সাংবিধানিক অধিকার’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

ক্ষমা প্রত্যাখ্যান ও দায় চাপানোর কৌশল

দ্য ইনডিপেনডেন্ট-এর কাছে দেওয়া মন্তব্যে, ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে কঠোরভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা এই সাবেক প্রধান বর্তমানে ভারতে নির্বাসনে রয়েছেন। গত বছর নিহত আন্দোলনকারীদের আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইবেন কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, "আমি আমাদের জাতি হিসেবে হারানো প্রতিটি সন্তান, ভাই-বোন, আত্মীয় ও বন্ধুর জন্য শোক প্রকাশ করি এবং তা করতে থাকব।”

তিনি গত বছরের বিক্ষোভ দমনের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করেন, তবে ব্যক্তিগতভাবে কোনো দায় নিতে নারাজ। বরং, তিনি এই প্রাণঘাতী ঘটনার জন্য 'মাঠপর্যায়ে থাকা নিরাপত্তা বাহিনীর শৃঙ্খলার পতনকেই' দায়ী করেছেন। তিনি আরও দাবি করেন, প্রথম দিকের হত্যাকাণ্ড নিয়ে তাঁর সরকারই একটি স্বাধীন তদন্ত শুরু করেছিল, যা পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বন্ধ করে দেয়।

এএফপি-কে তিনি বলেছেন, "আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে—আমি নিজে নিরাপত্তা বাহিনীকে জনতার ওপর গুলি চালাতে বলেছিলাম, এটা ঠিক নয়।" যদিও তিনি স্বীকার করেছেন যে, "চেইন অব কমান্ডের মধ্যে কিছু ভুল অবশ্যই হয়েছিল," তবে সামগ্রিকভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত ছিল ‘পরিমিত, সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, এবং যতটা সম্ভব প্রাণহানি কমানোর লক্ষ্যে’।

বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে চ্যালেঞ্জ ও হুমকির মুখে নির্লিপ্ততা

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোগীদের বিচার কার্যক্রম চলছে। ছাত্র আন্দোলনের সময় প্রায় ১,৪০০ মানুষের মৃত্যু এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আবেদন জানানো হয়েছে।

এই ১,৪০০ জনের মৃত্যুর সংখ্যাটিকে তিনি 'অতিরঞ্জিত' এবং 'ট্রাইব্যুনালের প্রচারণামূলক হাতিয়ার' হিসেবে অভিহিত করেছেন। বিচার প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “যদি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, তাতে আমি অবাক হব না বা ভয়ও পাব না।” এটিকে তিনি রাজনৈতিক বিদ্বেষপ্রসূত একটি ‘প্রহসনের বিচার’ এবং ‘অনির্বাচিত সরকার’ দ্বারা পরিচালিত একটি ‘প্রহসনের আদালত’ বলে উড়িয়ে দেন।

আদালতে প্রচারিত অডিও রেকর্ডিং, যেখানে তাঁকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিতে শোনা যায়, সেগুলোকে তিনি 'প্রসঙ্গের বাইরে কেটে নেওয়া ও বিকৃত করা হয়েছে' বলে দাবি করেছেন। দ্য ইনডিপেনডেন্ট অবশ্য মন্তব্য করেছে, শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই রায় ঘোষণা হবে এবং সম্ভবত তিনি জানেন ইতিহাস তাঁকে সদয়ভাবে বিচার করবে না।

অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের পক্ষে সওয়াল ও আল্টিমেটাম

অদ্ভুতভাবে, নিজেই পরপর তিনটি একপেশে নির্বাচনের আয়োজন করলেও এখন তিনি একটি ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক’ ভোটের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তাঁর প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

রয়টার্সকে তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন যে, আওয়ামী লীগকে বাদ রেখে কোনো নির্বাচন হলে তা দলটির লাখ লাখ সমর্থককে ভোটদান থেকে বিরত রাখবে। তিনি এটিকে শুধু ‘অবিচার’ নয়, বরং একটি ‘আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত’ হিসেবে বর্ণনা করে একটি কার্যকর রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য লাখ লাখ ভোটারকে বঞ্চিত না করার আহ্বান জানান। তাঁর দলকে সুযোগ না দিলে দেশে বিভেদ বাড়বে বলেও তিনি এএফপিকে জানিয়েছেন।

বাংলাদেশে তাঁর প্রত্যাবর্তন নির্ভর করবে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের ওপর। তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, তাঁর দল থাকবে না এমন সরকারের অধীনে তিনি দেশে ফিরবেন না এবং ভারতেই থাকার পরিকল্পনা করেছেন। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগ পরিচালনার জন্য তাঁর পরিবার দরকার নেই।

আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ও একটি নীরব প্রশ্নচিহ্ন

শেখ হাসিনা বারবার নিজের কৃতকর্মের দায় অস্বীকার করলেও, তাঁর শাসনামলে পরিচালিত দমন-পীড়ন আন্তর্জাতিক মহলে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একে ভিন্নমতের প্রতি 'অসহিষ্ণুতা' হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক ছাত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর আক্রমণকে 'অগ্রহণযোগ্য' বলে সমালোচনা করেছিলেন এবং জাতিসংঘের প্রতিবেদনে এটিকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের সবচেয়ে সহিংস ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষমতাচ্যুতির পর তাঁর সমর্থকদের গ্রেপ্তারের অভিযোগ তুললেও, তাঁর দীর্ঘ শাসনামলে গোপন আটককেন্দ্রে নিখোঁজ হওয়া শত শত মানুষের ভাগ্যের বিষয়ে তিনি কোনো আলোকপাত করেননি, যা একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন রেখে গেছে।

আল-মামুন/

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ