ঢাকা, শুক্রবার, ২১ নভেম্বর ২০২৫, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

Alamin Islam

Senior Reporter

ভূমিকম্পে কাঁপলো দেশ: ১৩টি এলাকা সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে

জাতীয় ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ নভেম্বর ২১ ১২:১২:৩৩
ভূমিকম্পে কাঁপলো দেশ: ১৩টি এলাকা সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে

দেশের ভূগর্ভস্থ পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যতের ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে এক আতঙ্কের খবর দিল গবেষণা মহল। গত শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে অনুভূত হওয়া মাত্র ২৬ সেকেন্ডের শক্তিশালী ভূকম্পন গোটা দেশে যে ভীতি সৃষ্টি করেছিল, তারই সূত্র ধরে গবেষকরা জানাচ্ছেন, ১৩টি ভূত্বকীয় চ্যুতি বা ফাটলের কারণে এই কম্পন অনুভূত হয়ে থাকতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের যৌথ গবেষণালব্ধ উপাত্তে জানা যাচ্ছে, দেশের মোট ১৩টি অঞ্চল এখন ভূমিকম্পের সম্ভাব্য কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা এবং সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকা সবচেয়ে তীব্র ভূমিকম্পের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে।

ঢাকার জন্য বিপদ সংকেত: সফট মাটির দুর্বলতা

ভূমিকম্পবিদদের মতে, সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এই এলাকাগুলো ঢাকা শহর থেকে কমপক্ষে ১০০ কিলোমিটার বা তার বেশি দূরত্বে অবস্থিত। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, সেখানে যদি রিখটার স্কেলে সাত থেকে আট মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে, তবে তার ফলস্বরূপ রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

দেশের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন, রাজধানীর ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটারের ব্যবধানে সাত থেকে আট মাত্রার ভূকম্পন ঘটলে ঢাকায় তীব্র কম্পন অনুভূত হবে। এই কম্পন শহরের নির্মাণগতভাবে দুর্বল ভবনগুলোকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক এবং সহ-উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামালের গবেষণা প্রতিবেদনে ঢাকা শহরের ভূমিরূপের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বলছেন, ঢাকা শহরের ৩০৫ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে:

৩৫ শতাংশ অঞ্চল লাল মাটির ওপর গঠিত, যা সাধারণত বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য উপযুক্ত।

বাকি ৬৫ শতাংশ এলাকা হলো নদীর তীরবর্তী কাদামাটি ও বালুমাটির স্তর, যার মধ্যে মোহাম্মদপুর, উত্তরা ও পূর্বাচল নতুন শহরের মতো এলাকা অন্তর্ভুক্ত। বেসরকারি আবাসন প্রকল্পগুলোর অধিকাংশই এই নরম মাটিতে গড়ে উঠেছে।

অধ্যাপক মাকসুদ কামাল সতর্ক করে বলেন, ঢাকাতে ৫ থেকে ৬ মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত হলেই এই নরম মাটির ওপর নির্মিত ভবনগুলো ভেঙে পড়া বা হেলে পড়ার ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। তিনি তুরস্কে হওয়া ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা থেকে দ্রুত শিক্ষা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

এছাড়াও, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অমান্য করে এই নরম ও দুর্বল মাটিতে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হলে, মাঝারি মাত্রার কম্পনেই তা ভেঙে পড়ার সমূহ আশঙ্কা থাকে। তবে লালমাটির ওপর নির্মিত এক থেকে তিনতলা ইমারতগুলোর ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম।

নির্মাণ শৈথিল্য ও প্রাণহানির ঝুঁকি

ভূমিকম্পজনিত কারণে যত প্রাণহানি হয়, তার নব্বই শতাংশের প্রধান কারণ হলো ভবনধস। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ভূমিকম্পগবেষক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১৩টি ভূগর্ভস্থ চ্যুতি থাকলেও, সেগুলোর সবগুলোই ঢাকা থেকে বেশ দূরে অবস্থিত। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটে যদি মাঝারি থেকে তীব্র ভূমিকম্প হয়, তাহলে রাজধানী ঢাকায় ভবনধসের ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি রানা প্লাজার উদাহরণ টেনে বলেন, ভূমিকম্প ছাড়াও যে ভবন ভেঙে পড়তে পারে, তার প্রমাণ রানা প্লাজার ধস।

অধ্যাপক হুমায়ুন আখতারের মতে, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ঢাকার অসংখ্য ভবন নির্মাণে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা এবং ভূমিরূপ সংক্রান্ত নিয়মাবলি কঠোরভাবে মানা হয়নি। এই কাঠামোগত ত্রুটির কারণে তুরস্কে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের চেয়ে কম মাত্রার ভূকম্পনও আমাদের জন্য বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের হিসাবে, ঢাকা শহরে মোট ২১ লাখ ভবন রয়েছে, যার মধ্যে ৬ লাখ ভবন ছয়তলা বা তার চেয়েও বেশি উঁচু। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞ মেহেদী হাসান আনসারী স্পষ্ট করে বলেন, ঢাকায় আইনকে উপেক্ষা করে নরম মাটিতে ভবন নির্মাণ বন্ধ করা না হলে একটি বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।

অসম্পূর্ণ প্রস্তুতি: রেট্রোফিটিংয়ের অভাব

২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর, বিদেশি ক্রেতাদের চাপের মুখে তৈরি পোশাক কারখানাগুলোকে রেট্রোফিটিং বা প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে ঝুঁকিমুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু আবাসিক ও অন্যান্য ভবনের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঝুঁকি হ্রাসকারী ব্যবস্থা (রেট্রোফিটিং) নেওয়া হয়নি। ফলে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেও ঢাকার কিছু ভবনের দেওয়ালে ফাটল দেখা গেছে এবং হেলে পড়ার ঘটনা ঘটেছে।

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর বুয়েট একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা দেয়— ঢাকার ভবনগুলোর ভূমিকম্প সহনশীলতা নির্ণয় করে একটি তালিকা তৈরি করা। এতে সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোকে লাল, মাঝারি ঝুঁকিযুক্ত ভবনগুলোকে হলুদ এবং সহনশীল ভবনগুলোকে সবুজ রং দিয়ে চিহ্নিত করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বুয়েট সূত্র অনুযায়ী, এই অত্যাবশ্যকীয় কাজটি এখনো সমস্ত ভবনের জন্য সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি।

ইতিহাসের পাঠ

বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এক যৌথ গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ১৮৯৭ সালে ভারতের আসামে রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার একটি প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল। ওই ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ঢাকা থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে ছিল। সেই সময় ঢাকায় মাত্র ১০০টি পাকা দালান ছিল এবং অধিবাসী ছিল ৯০ হাজার। সেই কম্পনে আহসান মঞ্জিলসহ ১০টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বর্তমানের দুর্বল কাঠামোগত প্রেক্ষাপটে এই ইতিহাস বড় ধরনের সতর্কবার্তা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপর্যয়ের আশঙ্কা এড়াতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি।

FAQ (Frequently Asked Questions) ও উত্তর

প্রশ্ন ১: ঢাকা থেকে ১০০ কিমি দূরে ভূমিকম্প হলে বিপর্যয় কেন ঘটবে?

উত্তর: গবেষকরা জানিয়েছেন, ঢাকার ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে সাত থেকে আট মাত্রার ভূমিকম্প হলে তীব্র কম্পন অনুভূত হবে, যা শহরের দুর্বল কাঠামো ও নরম মাটির ভবনগুলোর বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে।

প্রশ্ন ২: দেশের কোন কোন এলাকা সবচেয়ে তীব্র ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে?

উত্তর: ভূগর্ভস্থ ফাটল বা চ্যুতি থাকার কারণে দেশের ১৩টি এলাকা ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা ও সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকা সবচেয়ে তীব্র ঝুঁকিতে আছে।

প্রশ্ন ৩: ঢাকা শহরের কত শতাংশ এলাকা নরম মাটির ওপর গঠিত?

উত্তর: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামালের গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকা শহরের ৩০৫ বর্গকিলোমিটার এলাকার ৬৫ শতাংশ অঞ্চল মূলত নদীর তীরবর্তী কাদামাটি ও বালুমাটির, যা বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য দুর্বল।

প্রশ্ন ৪: ভূমিকম্পে মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণ কী?

উত্তর: ভূমিকম্পে মানুষের মৃত্যুর ৯০ শতাংশই হয় ভবনধসের কারণে। গবেষক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার এ বিষয়ে রানা প্লাজা ধসের উদাহরণ দেন।

প্রশ্ন ৫: বর্তমানে ঢাকা শহরে কতগুলো বহুতল ভবন (৬ তলা বা তার বেশি) রয়েছে?

উত্তর: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা শহরে মোট ২১ লাখ ভবন আছে, যার মধ্যে ৬ লাখ ভবন ছয়তলা বা তার চেয়ে উঁচু।

আরও পড়ুন:

ভূমিকম্পের কবলে মিরপুর টেস্টও, খেলার মধ্যে ঘটলো অবিশ্বাস্য ঘটনা

ভূমিকম্প হলে যে দোয়া পড়তে বলেছেন রাসূল (সা.)

ভূমিকম্প: এই সময় করণীয় কি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

ভূমিকম্পে কাঁপল বাংলাদেশ; আতঙ্কের মাঝেই গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিলেন আজহারী

ভূমিকম্পে ঢাকায় ভবন ধস, জানা গেল সারা দেশে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ

আল-মামুন/

পাঠকের মতামত:

ট্যাগ: বাংলাদেশ ঢাকা ভূমিকম্প মিরপুর টেস্ট হাদিসের দোয়া বাংলাদেশ বনাম আয়ারল্যান্ড bd news 24 bangladesh pratidin নফল নামাজ earthquake near me earthquake earthquake today ঢাকা ভূমিকম্প ভয়াবহ ভূকম্পন ভূকম্পন অনুভূত শুক্রবার ভূমিকম্প ২১ নভেম্বর ভূমিকম্প ১০টা ৩৯ মিনিটে ভূমিকম্প আজকের ভূমিকম্প earthquake alert earthquakes today today earthquake earthquake aftershock ভুমিকম্প ভূমিকম্প বাংলাদেশ আজকের ভূমিকম্প কোথায় হয়েছে ভূমিকম্পের মাত্রা ভূমিকম্প অনুভূত ভূমিকম্পের খবর ভূমিকম্প নিউজ আজকের ভূমিকম্পের মাত্রা কত ঢাকায় ভূমিকম্প কত মাত্রার ভূমিকম্প হলো আজকের ভূমিকম্পের মাত্রা recent earthquakes বাংলাদেশ ভূমিকম্প earthquake today in bangladesh earthquake dhaka today earthquake live today earthquake in bangladesh ভূমিকম্পের দোয়া bangladesh earthquake today earthquake bangladesh today earthquake in bangladesh today earthquake today bangladesh earthquake in bd bd earthquake today earthquake news দোয়া ইউনুস ভূমিকম্প হলে করণীয় ভূমিকম্প হলে কি করতে হয় বিপদ থেকে মুক্তির দোয়া আল্লাহর গজব দান সদকা ভূমিকম্পের সময় আমল earthquake in dhaka today ভূমিকম্পের সময় করণীয় ভূমিকম্প হলে কি করবেন ভূমিকম্প সতর্কতা ভূমিকম্প থেকে বাঁচার উপায় ভূমিকম্প নিরাপত্তা প্রাকৃতিক দুর্যোগে করণীয় গ্যাস চুলা বন্ধ লিফট ব্যবহার নয় বিশেষজ্ঞ পরামর্শ মাধবদী আজহারীর বার্তা ইসলাম ও ভূমিকম্প ফজরের নামাজ সূরা মুলক ঢাকা ভূমিকম্প ঝুঁকি ৭-৮ মাত্রার ভূমিকম্প নরম মাটির ভবন ভূমিকম্পে ভবনধস ১৩টি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা সিলেট পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিকম্প ভূমিকম্প সহনশীলতা মেহেদী হাসান আনসারী সৈয়দ হুমায়ুন আখতার ঢাকা বিপর্যয়ের শঙ্কা ভবন ধস দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা রেট্রোফিটিং বুয়েট গবেষণা রানা প্লাজা লালমাটি এলাকা

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ