ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ডিভিডেন্ড করেই বিনিয়োগকারীদের আয়ে ছুরি চালালো বাজেট

শেয়ারবাজার ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ জুন ১৩ ২১:৫৬:৫৩
ডিভিডেন্ড করেই বিনিয়োগকারীদের আয়ে ছুরি চালালো বাজেট

নিজস্ব প্রতিবেদক: শেয়ারবাজারের হাল ধরতে যখন প্রয়োজন ছিল সাহসী ও দূরদর্শী বাজেট, তখনই প্রস্তাবিত বাজেটে ডিভিডেন্ড আয়ের উপর অতিরিক্ত করের বোঝা বিনিয়োগকারীদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে—যার ফলে বাজারে ভর করেছে অনিশ্চয়তার মেঘ। বিশেষত উচ্চ নিট সম্পদধারী ব্যক্তিদের জন্য এই করের হার কার্যকরভাবে ৪০.৫০ শতাংশে গিয়ে ঠেকায় অনেকেই বলছেন, এটা যেন শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতার গলায় ফাঁসির দড়ি।

সরকারি পর্যায়ে আশ্বাস মিললেও বাজেট প্রস্তাবনায় কাঙ্ক্ষিত কোনো সংশোধনের ছাপ মেলেনি। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী একদিকে যেমন ডিভিডেন্ড মৌসুমে শেয়ার বিক্রির চাপ নিয়ে সরকারের উদ্বেগ দূর করার আশ্বাস দিয়েছেন, অন্যদিকে বাজেটে বাস্তবতাকেন্দ্রিক সমাধান অনুপস্থিত থেকে গেছে।

ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম এই প্রস্তাবনায় হতাশ হলেও এখনও আশাবাদী। তিনি বলেন, “আমরা সংশোধনের প্রত্যাশা করেছিলাম। বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে—তবে এখনও সময় আছে। সরকারকে অনুরোধ করছি চূড়ান্ত বাজেট অনুমোদনের আগে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করুন।”

উচ্চ কর: ডিভিডেন্ড সংস্কৃতির মৃত্যুঘণ্টা?

বাংলাদেশের শেয়ারবাজার এখনও মূলত অনুমাননির্ভর। এর পেছনে বড় কারণ—অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও জটিল কর কাঠামো।

প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজের সিইও মো. মনিরুজ্জামান বলেন, “যেখানে মূলধনী লাভে ১৫ শতাংশ কর, সেখানে ডিভিডেন্ডে ৪০.৫০ শতাংশ কর কেন? এমন বৈষম্য বাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করে, আর শেয়ারহোল্ডারদের ন্যায্য আয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করে।”

তিনি আরো বলেন, “এই কর নীতিই অনেক প্রতিষ্ঠানকে ডিভিডেন্ড দেওয়া থেকে বিরত রাখে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন সংখ্যালঘু বিনিয়োগকারীরা। আর দেশের বাজারে এমনিতেই ভালো ডিভিডেন্ড দেওয়া কোম্পানির সংখ্যা হাতে গোনা।”

কেন এই কর কাঠামো প্রশ্নবিদ্ধ?

বর্তমানে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা তাদের আয়ের স্তর অনুযায়ী ০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কর দেন। কিন্তু যাদের বার্ষিক নিট সম্পদ ৫০ কোটি টাকার বেশি, তারা সরাসরি ৪০.৫০ শতাংশ করের বেড়াজালে পড়েন—যার মধ্যে আছে ১৫ শতাংশ উৎসে কর, ৩০ শতাংশ ইনকাম ট্যাক্স, আর তার ওপর ৩৫ শতাংশ সারচার্জ।

অন্যদিকে কর্পোরেট শেয়ারহোল্ডারদের জন্য এই হার ২০ শতাংশ, আর মূলধনী লাভে রয়েছে মাত্র ১৫ শতাংশ কর। এমন অসামঞ্জস্য বাজারে দীর্ঘমেয়াদি অংশগ্রহণের উৎসাহ কমায়, এমনটাই মনে করছেন কর বিশেষজ্ঞ আব্দুল কাদের।

তার ভাষায়, “এই কাঠামোতে সরকার ক্ষণিকের কর আদায় পেলেও বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে এর খেসারত দিতে হবে বাজারকে।”

প্রস্তাব: একটি বিনিয়োগবান্ধব কর কাঠামো

ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন প্রস্তাব দিয়েছে, ডিভিডেন্ডের উপর কর হার ১৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ করা হোক—যা মূলধনী লাভ করের হারকে অনুসরণ করে। এর ফলে কর কাঠামো ভারসাম্যপূর্ণ হবে, বিনিয়োগকারীদের স্বস্তি আসবে এবং কোম্পানিগুলোও ডিভিডেন্ড দিতে উৎসাহিত হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কিছু কর রাজস্ব ছাড় দিয়ে এখন যদি একটি স্থিতিশীল, স্বচ্ছ এবং আস্থা-নির্ভর শেয়ারবাজার গড়া যায়, তবে সেটিই ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বড় লাভ।

আস্থা ফিরিয়ে আনতে সংস্কার জরুরি

যে শেয়ারবাজার অর্থনীতির হৃদপিণ্ড হওয়ার কথা, সেই বাজার এখন কর বৈষম্যের চাপে জর্জরিত। ডিভিডেন্ডের উপর উচ্চ কর শুধু বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করছে না, এটি কোম্পানিগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহও ব্যাহত করছে।

সরকার যদি সত্যিই একটি শক্তিশালী পুঁজিবাজার চায়, তবে বাজেটের চূড়ান্ত অনুমোদনের আগেই সময় এসেছে সাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার। ডিভিডেন্ড কর কাঠামোতে সংস্কার আনলে সেটি হবে বিনিয়োগকারীদের জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস—আর শেয়ারবাজারের জন্য একটি নবজাগরণের সূচনা।

মো: রাজিব আলী/

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ