ঢাকা, শনিবার, ৯ আগস্ট ২০২৫, ২৫ শ্রাবণ ১৪৩২

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশের টেক্সটাইল খাত

শেয়ারনিউজ ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ আগস্ট ০৯ ২২:২৬:৪৬
ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশের টেক্সটাইল খাত

নিজস্ব প্রতিবেদক: যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক বৃদ্ধির আশঙ্কায় দেশের টেক্সটাইল খাতে যে স্থবিরতা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল, তা অবশেষে কাটতে শুরু করেছে। দীর্ঘ আলোচনার পর মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিরা একটি নতুন শুল্ক হার নির্ধারণ করেছেন, যা প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশকে সুবিধাজনক অবস্থানে রেখেছে। এর ফলে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত শুধু ঘুরে দাঁড়ানোরই নয়, বরং মার্কিন পোশাকের বাজারে নিজেদের হিস্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানোর সুযোগ পাবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এই ইতিবাচক পরিবর্তনের খবরে দেশের শেয়ারবাজারেও টেক্সটাইল খাতের শেয়ারগুলোর প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

নতুন শুল্ক কাঠামো ও প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অবস্থান:

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ওপর ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক (Countervailing Duty) আরোপ করা হয়েছে। এর সাথে আগে থেকে বিদ্যমান ১৬.৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক যোগ হওয়ায় মোট কার্যকর শুল্ক হার দাঁড়িয়েছে ৩৬.৫ শতাংশ। আপাতদৃষ্টিতে এই হার বেশি মনে হলেও প্রতিযোগী দেশগুলোর দিকে তাকালে ছবিটি স্পষ্ট হয়। যেখানে ভিয়েতনামকে ৫০ শতাংশ, ভারতকে ৬৬.৫ শতাংশ এবং চীনকে প্রায় ৫৫ শতাংশ শুল্কের বোঝা বহন করতে হবে, সেখানে বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত ৩৬.৫ শতাংশ শুল্ক একটি বড় স্বস্তির বিষয়।

এই তুলনামূলক কম শুল্কের কারণে মার্কিন ব্র্যান্ড ও আমদানিকারকরা বাংলাদেশকে তাদের প্রধান সোর্সিং গন্তব্য হিসেবে বেছে নিতে পারে। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ৮৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাকের বাজারে বাংলাদেশের ৯.৩ শতাংশ অংশীদারিত্ব ছিল। নতুন এই শুল্ক কাঠামোর ফলে এই হিস্যা আরও বাড়ার অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। শিল্পখাতের প্রতিক্রিয়া: স্বস্তির সাথে সতর্কতা:

নতুন এই শুল্ক হারকে স্বাগত জানিয়েছেন দেশের পোশাক রপ্তানিকারকরা। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অন্যতম বৃহৎ পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ এই হারকে "স্বস্তিদায়ক" বলে অভিহিত করেছেন। তবে তিনি একটি ঝুঁকির কথাও উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, মার্কিন আমদানিকারকরা এই অতিরিক্ত শুল্কের একটি অংশ বাংলাদেশি উৎপাদকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, যা রপ্তানিকারকদের মুনাফা কমিয়ে দিতে পারে।

বিজিএমইএ-এর সভাপতি মাহমুদ হাসান খানও রপ্তানি বাড়ার বিষয়ে আশাবাদ প্রকাশ করেছেন। তবে তিনিও সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো বাড়তি শুল্কের বোঝা সরবরাহকারীদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করতে পারে, যা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। অন্যদিকে, বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান এই আলোচনাকে "অত্যন্ত ইতিবাচক" হিসেবে দেখছেন এবং শুধু পোশাক নয়, জুতা, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানিও এর ফলে বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। সুবিধার নেপথ্যে কারণ:

প্রতিযোগীদের চেয়ে কম শুল্কের এই সুবিধা পাওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে।

১. তুলা নির্ভরতা: বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের একটি বড় অংশ তুলা দিয়ে তৈরি, যা সিনথেটিক বা মানবসৃষ্ট সুতার পোশাকের চেয়ে কম শুল্কের আওতায় পড়েছে।

২. মার্কিন তুলার ব্যবহার: চুক্তির একটি বিশেষ দিক হলো, যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত তুলা ব্যবহার করে পোশাক তৈরি করলে নির্দিষ্ট পরিমাণে শুল্ক ছাড় পাওয়া যাবে। দেশের কিছু রপ্তানিকারক ইতোমধ্যে তাদের পণ্যে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত মার্কিন তুলা ব্যবহার করছেন, যা তাদের জন্য শুল্কের হার আরও কমিয়ে আনবে।

চ্যালেঞ্জ ও শর্তাবলী:

এই সুযোগের সাথে কিছু বড় চ্যালেঞ্জ এবং শর্তও জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

বাজার সংকোচন: কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানির বাজার ছিল ১০৫ বিলিয়ন ডলার, যা এখন ৮৫ বিলিয়নে নেমেছে। উচ্চ শুল্কের কারণে এই বাজার আরও সংকুচিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। মোট ক্রয়াদেশ কমে গেলে, কম শুল্কের সুবিধা থেকেও কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া কঠিন হবে।

দ্বিপাক্ষিক শর্ত: এই শুল্ক সুবিধা নিঃশর্ত নয়। এর বিনিময়ে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে উড়োজাহাজ, গম, সয়াবিন ও তুলার মতো পণ্য আমদানি বাড়াতে হবে। একই সাথে, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার মার্কিন দুগ্ধ, মাংস ও পোলট্রি পণ্যের জন্য উন্মুক্ত করার মতো শর্তও রয়েছে। চীনের ওপর কাঁচামালের নির্ভরতা কমানোর জন্যও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চাপ রয়েছে।

সব মিলিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক ব্যবস্থা বাংলাদেশের টেক্সটাইল খাতের জন্য একটি বড় সুযোগ তৈরি করেছে। দীর্ঘদিনের শঙ্কা কাটিয়ে এটি রপ্তানিকারকদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। তবে মুনাফা ঠিক রেখে বর্ধিত শুল্কের বোঝা মোকাবেলা করা এবং চুক্তির শর্তগুলো পূরণ করা হবে আগামী দিনের মূল চ্যালেঞ্জ। যদি সরকার ও বেসরকারি খাত সম্মিলিতভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সুযোগকে কাজে লাগাতে পারে, তবে এটি দেশের অর্থনীতি ও শেয়ারবাজার উভয়ের জন্যই একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করবে। বিনিয়োগকারীরাও এখন এই খাতের দিকে নিবিড়ভাবে তাকিয়ে আছেন, যা টেক্সটাইল খাতের শেয়ারগুলোর জন্য একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

আল-আমিন ইসলাম/

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ