ঢাকা, সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৭ আশ্বিন ১৪৩২

MD. Razib Ali

Senior Reporter

শেয়ারবাজারে প্রতারণা: গোপন কারসাজিতে নিঃস্ব হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা!

শেয়ারনিউজ ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ সেপ্টেম্বর ২২ ১৪:১০:০৫
শেয়ারবাজারে প্রতারণা: গোপন কারসাজিতে নিঃস্ব হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা!

বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে সম্প্রতি এক নতুন ধরনের প্রতারণার চিত্র সামনে এসেছে, যেখানে কিছু তালিকাভুক্ত কোম্পানি 'সুনির্দিষ্ট কৌশল' প্রয়োগ করে নিজেদের শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে নিচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, এই অনৈতিক প্রক্রিয়ায় সংঘবদ্ধ চক্র নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং স্টক এক্সচেঞ্জকে অন্ধকারে রেখে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, যার চরম মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। মাত্র দুই সপ্তাহ থেকে দুই মাসের মধ্যে কিছু শেয়ারের মূল্য প্রায় দ্বিগুণ হওয়া এই প্রতারণার ভয়াবহতাকেই নির্দেশ করে।

কৃত্রিম দরবৃদ্ধি: এক চক্রের লাভ, অন্য চক্রের সর্বনাশ

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, এই চক্রগুলো অবৈধভাবে শেয়ারের কৃত্রিম দরবৃদ্ধি ঘটিয়ে লাভবান হচ্ছে। তারা 'আঙুল ফুলে কলাগাছ' হলেও, নিরীহ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, কিছু বিনিয়োগকারী মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে কোটি কোটি টাকা লাভ করছেন, আর এই লোকসান চাপানো হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাঁধে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতারণা

সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, অনেক কোম্পানি তথ্য গোপন করে এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জের চোখে ধুলো দিয়ে নিয়মিত প্রতারণা করে চলেছে। কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দর বাড়িয়ে তারা অবৈধ সুবিধা নিচ্ছে। কখনও কখনও কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরাও এই কারসাজিতে জড়িত থাকছেন, নিজেদের মালিকানার শেয়ার উচ্চমূল্যে বিক্রি করে বিপুল অঙ্কের অর্থ উপার্জন করছেন। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।

পরিকল্পিত কারসাজি ও ভেতরের তথ্য ফাঁস

বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই কারসাজিগুলো পূর্ব পরিকল্পিত। কোম্পানিগুলো তাদের গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্য সংবেদনশীল সিদ্ধান্ত কিছু বিশেষ বিনিয়োগকারীর কাছে আগেভাগেই ফাঁস করে দেয়। এই বিশেষ বিনিয়োগকারীরা তখন কম দামে শেয়ার কিনে বাজারে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে। এরপর ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়লে শেয়ারের দর হঠাৎ করে বাড়তে শুরু করে। কিন্তু এই কৃত্রিম দরবৃদ্ধি বেশিদিন স্থায়ী হয় না, যার ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন।

অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি পাওয়া কিছু শেয়ারের চিত্র:

কিছু কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে:

কে অ্যান্ড কিউ (বাংলাদেশ) লিমিটেড: দুই মাসে শেয়ারের দর প্রায় ৯৩% বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। শুরুতে 'কারণ জানি না' বললেও, পরে তারা নতুন এলপিজি ইউনিট চালু এবং মুনাফা বৃদ্ধির সম্ভাবনার কথা জানায়।

সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস লিমিটেড: ২৯ জুলাই থেকে শেয়ারের দাম ৯৭% বেড়েছে। প্রথমে 'কারণ জানি না' বললেও, পরে নতুন উৎপাদন ইউনিট চালুর ঘোষণা দেয়।

মাগুরা কমপ্লেক্স পিএলসি: ১৭ কার্যদিবসে শেয়ারের দর প্রায় ৩১% বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ 'অজ্ঞাত' বললেও, পরে নতুন মেশিনারিজ কেনার কথা জানায়।

মনোস্পুল বাংলাদেশ পিএলসি: ২৯ জুলাই থেকে শেয়ারের দর ২৫% বেড়েছে। শুরুতে 'কারণ জানি না' জানালেও, পরে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে মেশিনারিজ কেনার কথা বলে।

মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড: মাত্র ১৩ কার্যদিবসে শেয়ারের দাম ৩২% বেড়েছে। 'কারণ জানি না' বলার পর, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) তাদের থেকে ৫০% ব্যাগ ক্রয়ের নিশ্চিত খবর প্রকাশ করে, যা মুনাফা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।

বিশেষজ্ঞদের কঠোর পদক্ষেপের আহ্বান:

বাজার বিশ্লেষকরা স্টক এক্সচেঞ্জ এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আরও সক্রিয় ও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন বলেন, "মূল্য সংবেদনশীল তথ্য গোপন করা স্পষ্টত প্রতারণা। আমাদের দেশে কোম্পানির জবাবদিহিতা এখনও দুর্বল। এই সমস্যা মোকাবিলায় যথাযথ গাইডলাইন ও কঠোর নজরদারি অপরিহার্য।"

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, "স্টক এক্সচেঞ্জের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে, যা কোম্পানির প্রতারণাকে চিহ্নিত করতে বাধা দিচ্ছে। স্টক এক্সচেঞ্জকে তার সক্ষমতা বাড়াতে হবে।"

বিএসইসি মুখপাত্র মো. আবুল কালামের মতে, "ইনসাইডার ট্রেডিং নিষিদ্ধ এবং প্রমাণিত হলে কঠোর জরিমানা করা হবে। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।" ডিএসই চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম যোগ করেন, "কোম্পানির মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের নির্দিষ্ট সময় রয়েছে, এর আগে প্রকাশ করা নিষিদ্ধ। ইনসাইডার ট্রেডিং থাকলে তা তদন্ত করা হবে। আমাদের সার্ভিলেন্স ক্ষমতা বাড়ানোর কাজ চলছে।"

বিনিয়োগকারীদের সতর্কতা ও নিয়ন্ত্রকদের সক্রিয়তা জরুরি:

শেয়ারবাজারে সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করা অত্যাবশ্যক। একই সাথে, বিনিয়োগকারীদেরও শেয়ার কেনাবেচার আগে সতর্ক থাকতে এবং তথ্য যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

আরও পড়ুন:

সরকারি নির্দেশ, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ক্ষোভ, বিএসইসির কাছে আবেদন

বোর্ড সভার তারিখ জানাল তিন কোম্পানি, আসছে ডিভিডেন্ড

বড় খবর! সাকিবসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে শেয়ার কারসাজির তদন্ত নতুন মোড়

শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ণ সব খবর এখানে, জানুন এখনই

আল-মামুন/

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ