ঢাকা, সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

Alamin Islam

Senior Reporter

মৃত্যুদণ্ডাদেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হস্তান্তর করবে ভারত?

জাতীয় ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ নভেম্বর ১৭ ১৬:৫৯:২১
মৃত্যুদণ্ডাদেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হস্তান্তর করবে ভারত?

ভারতের মাটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কি এবার দেশের হাতে তুলে দেওয়া হবে? গত বছর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্র ও সাধারণ জনগণের ওপর পরিচালিত অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাঁকে সর্বোচ্চ সাজার রায় ঘোষণার পর এই প্রশ্নটিই এখন প্রধান আলোচ্য বিষয়।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাঁর এই দণ্ডাদেশ ঘোষণা করা হয়েছে। সোমবার, বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর তিন সদস্যের বেঞ্চ এই ঐতিহাসিক রায় প্রদান করে। রায় ঘোষণার সময় এজলাস কক্ষ আইনজীবীর ভিড়ে পূর্ণ ছিল; সাথে উপস্থিত ছিলেন জুলাই-আগস্টের সংঘর্ষে নিহতদের স্বজনরাও।

ট্রাইব্যুনাল জানিয়েছে, হাসিনার বিরুদ্ধে আনীত তিনটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে একটি অভিযোগে তাঁকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং বাকি দুটি অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড আরোপ করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই বিচারকার্য শুরু হওয়ার পূর্বেই বাংলাদেশ সরকার শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় নথি প্রতিবেশী ভারতের কাছে পাঠিয়েছিল। দুটি দেশের মধ্যে বন্দি বিনিময় চুক্তি কার্যকর থাকা সত্ত্বেও, এখন পর্যন্ত ভারত এই প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো সরকারি মতামত প্রকাশ করেনি। সোমবার ফাঁসির রায় ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই তাঁকে ভারতের ফেরত পাঠানো হবে কি না, তা নিয়ে নতুন করে জল্পনা শুরু হয়েছে।

বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ: প্রত্যর্পণ করবে না ভারত

এই রায় ঘোষণার পর, কাতার-ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন, ‘‘হাসিনার বিরুদ্ধে আদালতের এমন সিদ্ধান্ত অনুমিতই ছিল। তবে এই পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ভারত বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করবে না।’’

তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘‘বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেকার সম্পর্ক গত প্রায় দেড় বছর ধরে নড়বড়ে ও ভঙ্গুর থাকার কারণে ভারত কোনো পরিস্থিতিতেই তাঁকে প্রত্যর্পণ করবে না।’’

বিশেষজ্ঞ দত্ত আরও মন্তব্য করেন, কঠিন বিচার হওয়ার বিষয়টি দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি থেকেই সকলের কাছে প্রত্যাশিত ছিল। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরাও ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে ট্রাইব্যুনালের প্রক্রিয়া বাংলাদেশের আইনি কাঠামোর আওতায় পরিচালিত হয়েছে। অধ্যাপক দত্তের ভাষ্যমতে, ‘‘নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার উপর সংঘটিত অপরাধ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই এবং প্রধানমন্ত্রী সরাসরি গুলি চালানোর নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তার প্রমাণও রয়েছে।’’

তিনি মনে করেন, আওয়ামী লীগ এর বিপরীতে একটি যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেও, সামগ্রিক বাংলাদেশি জনমত মনে করে হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হয়েছেন।

প্রত্যাবাসন চুক্তির কাঠামো

২০১৩ সালে ভারত ও বাংলাদেশ একটি দ্বিপাক্ষিক প্রত্যাবাসন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে চুক্তিটির সংশোধন আনা হয়, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল দুই দেশের মধ্যেকার পলাতক আসামি ও বন্দিদের বিনিময়কে আরও মসৃণ ও দ্রুত করা।

এই চুক্তির প্রেক্ষাপট ছিল মূলত উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বহু পলাতক আসামির বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ এবং একইসাথে জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর মতো জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের ভারতে (পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম) লুকিয়ে থাকার সমস্যা মোকাবিলা করা। চুক্তিটির কার্যকারিতা ২০১৫ সালে স্পষ্টভাবে দেখা যায়, যখন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) শীর্ষ নেতা অনুপ চেটিয়াকে বাংলাদেশ থেকে সফলভাবে ভারতে প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ পরে আরও একজন পলাতক আসামিকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। একইভাবে, ভারতও অতীতে বাংলাদেশের কয়েকজন পলাতককে ঢাকার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে।

চুক্তির শর্তানুযায়ী, ভারত ও বাংলাদেশের এমন ব্যক্তিদের একে অপরের কাছে প্রত্যাবাসন করার কথা, যারা হয় মামলার শিকার, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, যারা দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, অথবা অনুরোধকারী দেশের আদালতের মাধ্যমে প্রত্যাবাসনযোগ্য অপরাধ করেছেন এবং যাদেরকে সেই দেশ ফেরত নিতে ইচ্ছুক।

কূটনৈতিক জটিলতা ও আইনি প্রক্রিয়া

যদিও ২০১৩ সালের চুক্তির ভিত্তিতে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়ার অধিকার বাংলাদেশের আছে, তবুও এই প্রক্রিয়ায় ভূ-রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাবের কারণে ব্যাপক জটিলতা বিদ্যমান। যদি ভারত তাঁকে প্রত্যাবাসন করতে রাজিও হয়, তবে এই কার্যক্রমটি ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যাবাসন চুক্তির মূলনীতি এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে একাধিক ধাপ অতিক্রম করবে।

পাঞ্জাবের রাজীব গান্ধী ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব ল-এর সহকারী অধ্যাপক এবং আইন বিশেষজ্ঞ ড. সঙ্গীতা তাক গত ফেব্রুয়ারিতে মন্তব্য করেছিলেন, যদিও কৌশলগত বা পারিভাষিক বিষয়গুলি মূলত প্রত্যাবাসন চুক্তির শর্ত দ্বারা নির্ধারিত হয়, তবুও রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং মানবাধিকার সংক্রান্ত কারণগুলো এই চুক্তিটিকে অত্যন্ত কঠিন ও স্পর্শকাতর বিষয়ে পরিণত করবে।

তাকের মতে, বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে হাসিনার প্রত্যর্পণের অনুরোধ জমা দিয়ে প্রক্রিয়াটি শুরু করেছে। এই অনুরোধে অবশ্যই হাসিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিস্তারিত বিবরণ, পাশাপাশি বিচারিক আদেশ, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এবং অন্যান্য সমর্থনকারী দলিলের একটি শক্তিশালী প্রমাণ সংগ্রহ অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। তিনি আরও জোর দিয়েছিলেন যে, প্রত্যাবাসনের অনুরোধের অংশ হিসেবে এই নিশ্চয়তা প্রদান আবশ্যক যে বাংলাদেশে তাঁর একটি ন্যায্য ও পক্ষপাতহীন বিচার নিশ্চিত করা হবে।

FAQ (Frequently Asked Questions) ও উত্তর

Q1: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাকে কী রায় দিয়েছেন?

A: ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের তিনটি অভিযোগের ভিত্তিতে শেখ হাসিনাকে একটিতে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং অন্য দুটি অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন।

Q2: শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কোন সময়ের অপরাধের জন্য সাজা ঘোষণা করা হয়েছে?

A: গত বছরের জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতার ওপর সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাঁর এই সাজা ঘোষণা করা হয়েছে।

Q3: প্রত্যর্পণ ইস্যুতে ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্তের মতামত কী?

A: অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্তের মতে, ভারত কোনো অবস্থাতেই শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেবে না, কারণ গত দেড় বছরে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক ভঙ্গুর মনে হয়েছে।

Q4: ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক প্রত্যর্পণ চুক্তি কবে স্বাক্ষরিত হয়?

A: ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে ২০১৩ সালে দ্বিপাক্ষিক প্রত্যর্পণ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং ২০১৬ সালে এটি সংশোধন করা হয়।

Q5: প্রত্যর্পণের অনুরোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কী ধরনের নিশ্চয়তা প্রদান আবশ্যক?

A: আইন বিশেষজ্ঞ ড. সঙ্গীতা তাকের মতে, প্রত্যর্পণের অনুরোধে অবশ্যই এই নিশ্চয়তা অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে যে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার একটি ন্যায্য ও পক্ষপাতমূলক নয় এমন বিচার হবে।

আল-মামুন/

পাঠকের মতামত:

ট্যাগ: ভারত শেখ হাসিনা বাংলাদেশ রাজনীতি আসাদুজ্জামান খান কামাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধ মৃত্যুদণ্ড আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল মুজিবকন্যা hasina international crimes tribunal news today bangladesh news sheikh hasina verdict time শেখ হাসিনার মামলার রায় sheikh hasina ray রায় শেখ হাসিনা মৃত্যুদণ্ড হাসিনা ভারত রাজনৈতিক রায় মানবাধিকার লঙ্ঘন অভিযোগ অধ্যাপক আসিফ নজরুল এক্সিএমপি হাসিনা মৃত্যুদণ্ডের রায় আসাদুজ্জামান কামাল মৃত্যুদণ্ড শেখ হাসিনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হাসিনা ভারতে মুজিবকন্যা প্রতিক্রিয়া প্রথম মহিলা মৃত্যুদণ্ড বাংলাদেশ হাসিনা প্রত্যর্পণ sheikh hasina asaduzzaman khan al jazeera chowdhury abdullah al-mamun today news live news verdict dhaka tribune news bangladesh ধানমন্ডি ৩২ শেখ হাসিনা রায় প্রত্যর্পণ বন্দি বিনিময় চুক্তি জুলাই আগস্ট অভ্যুত্থান শ্রীরাধা দত্ত ড. সঙ্গীতা তাক ভারত হাসিনা প্রত্যর্পণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রায় মানবতাবিরোধী অপরাধ হাসিনা ভারত বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তি শেখ হাসিনার ফাঁসি শ্রীরাধা দত্ত বিশ্লেষণ জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান রাজনৈতিক প্রত্যর্পণ জটিলতা

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ