পিআর পদ্ধতির সুফল, চ্যালেঞ্জ ও বাংলাদেশের বাস্তবতা কী?

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয় যে, নির্বাচনী পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক কখনোই থেমে থাকেনি। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও আমরা একটি সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। প্রতি পাঁচ বছর পরপর জাতীয় নির্বাচন ঘিরে সন্দেহ, সহিংসতা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে নতুন করে আলোচনায় এসেছে ‘আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা’, সংক্ষেপে পিআর পদ্ধতি।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত ‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট’ পদ্ধতিতে (FPTP) যে প্রার্থী সর্বাধিক ভোট পান, তিনিই নির্বাচিত হন। এতে একটি আসনে ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েও কেউ জিতে যেতে পারেন, আবার ২০-২৫ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয় অবস্থানে থাকা প্রার্থীরা সংসদের বাইরে থেকে যান। এই বৈষম্য ঘোচাতে ও জনগণের ভোটের প্রকৃত মূল্যায়নের দাবি থেকেই পিআর পদ্ধতির কথা উঠে এসেছে।
পিআর পদ্ধতির ধারণা ও বিশ্বপ্রেক্ষিত
আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতিতে একটি দল নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পায়, সংসদে তাদের তত শতাংশ আসন নিশ্চিত হয়। ব্যক্তিগত প্রার্থীর পরিবর্তে ভোটাররা দলকে ভোট দেন। এরপর দল একটি প্রস্তুত তালিকা থেকে নির্দিষ্ট অনুপাতে সংসদ সদস্য মনোনীত করে। বর্তমানে জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ডসহ প্রায় ৮০টির বেশি দেশে এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
এ ব্যবস্থায় কোনো একটি দলকে সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম থাকে, ফলে সরকার গঠনে জোট বাধার প্রয়োজন হয়। এতে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে সরকার পরিচালিত হয়, যা সিদ্ধান্ত গ্রহণে পরামর্শ এবং সহমতের চর্চা বাড়ায়।
সুফল: ভোটের প্রকৃত মূল্যায়ন ও অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি
১. ভোটের সমান মূল্যায়ন
এই পদ্ধতিতে প্রত্যেকটি ভোটের প্রভাব থাকে। এমনকি ৫ শতাংশ ভোট পেয়েও কোনো দল সংসদে আসন পেতে পারে, যা বর্তমান ব্যবস্থায় প্রায় অসম্ভব।
২. ছোট দলের সুযোগ
আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে যেসব দল জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ করে, যেমন জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ ইত্যাদি, তারা বর্তমান ব্যবস্থায় খুব কম আসন পায়। পিআর চালু হলে তারা ভোট অনুযায়ী আসন পাবে।
৩. ভবিষ্যৎ জাতীয় ঐকমত্য সরকার গঠনের সম্ভাবনা
যেহেতু একক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় না, তাই সরকার গঠনে আলোচনা ও জোট অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এতে কোনো একক দল স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না।
৪. রাজনৈতিক সহনশীলতা বাড়ানো
যেহেতু সরকারে যাওয়ার জন্য দলগুলোকে জোট গঠনে উৎসাহিত হতে হয়, তাই মতানৈক্য কমে এবং মতাদর্শভিত্তিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
৫. ভোটের হার বাড়ে
পিআর পদ্ধতিতে স্বল্প সমর্থিত দলগুলোও জয়ের সুযোগ পায়, তাই মানুষ উৎসাহী হয়ে ভোট দিতে যায়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এটি পরীক্ষিত সত্য।
চ্যালেঞ্জ: বাস্তবায়নের কাঠামোগত ও সাংগঠনিক দুর্বলতা
১. দলীয় অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অভাব
এই পদ্ধতিতে আগেভাগে ৩০০ প্রার্থীর তালিকা তৈরি করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো মনোনয়ন হয় পরিবারতন্ত্র, পেশিশক্তি ও পয়সার ভিত্তিতে। ফলে স্বচ্ছ ও দক্ষ প্রার্থী নির্বাচন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
২. জনসচেতনতার ঘাটতি
প্রচলিত ভোট পদ্ধতির বাইরে এই ব্যবস্থার কাঠামো অনেক জটিল। ভোটাররা যদি না বোঝে, তাহলে বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে।
৩. দুর্বল ও জোটনির্ভর সরকার গঠনের ঝুঁকি
এ ব্যবস্থায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কঠিন। ফলে সরকার গঠনে ছোট ছোট দলের ওপর নির্ভর করতে হয়, যারা অনেক সময় অতিরিক্ত সুবিধা দাবি করে। এতে নীতি বাস্তবায়নে দুর্বলতা দেখা দিতে পারে।
৪. স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য কোনো জায়গা নেই
বর্তমানে সংসদে নির্দলীয় বা স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অংশ নিতে পারবেন না, কারণ ভোট হয় দলভিত্তিক।
৫. আইনগত ও সাংবিধানিক জটিলতা
এই পদ্ধতিতে যেতে হলে সংবিধানে পরিবর্তন, নির্বাচন কমিশনের কাঠামো বদল এবং একটি সমন্বিত জাতীয় রাজনৈতিক ঐক্যমত জরুরি, যা বর্তমান বাস্তবতায় অনুপস্থিত।
রাজনৈতিক বাস্তবতা: কারা পক্ষে, কারা বিপক্ষে
আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ বেশ কিছু দল। তারা বলছে, “৩০ শতাংশ ভোটে সরকার গঠনের নামে বাকি ৭০ শতাংশ জনগণের মত উপেক্ষা করা হচ্ছে।” ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, “আমরা চাই, প্রতিটি ভোটের যথাযথ মূল্যায়ন হোক।”
অন্যদিকে, বিএনপি ও তাদের যুগপৎ আন্দোলনের অংশীদার দলগুলো পিআর ব্যবস্থার বিরোধিতা করছে। তাদের মতে, এই ব্যবস্থার পেছনে রাজনৈতিক ফাঁদ রয়েছে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, “যারা পিআর দাবি করছে, তারা আসলে সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় থাকতে চায়।”
বাস্তবতা: এখনই পুরোপুরি পিআর কি সম্ভব?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হঠাৎ করে জাতীয় সংসদে পিআর ব্যবস্থা চালু করা হলে সেটা হবে একপ্রকার বিশৃঙ্খলার সূত্রপাত। অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, “এই পদ্ধতি ভালো, কিন্তু তা বাস্তবায়নের জন্য আমাদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি নেই।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, “পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সংসদে বহু দল ঢুকবে। এতে সরকার দুর্বল হবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনৈক্য দেখা দেবে।”
সম্ভাব্য সমাধান: ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন
অনেক বিশ্লেষক পরামর্শ দিচ্ছেন, পিআর পদ্ধতি হুট করে জাতীয় নির্বাচনে নয়, বরং স্থানীয় সরকার বা সম্ভাব্য সংসদের উচ্চকক্ষে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
১. সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা নির্বাচন
নির্বাচনী ব্যবস্থায় জনগণের প্রতিক্রিয়া পর্যালোচনার সুযোগ পাওয়া যাবে।
২. সাংবিধানিক উচ্চকক্ষ গঠন (যদি হয়)
এই কক্ষে পিআর ভিত্তিক নির্বাচন হতে পারে, যেখানে নীতিনির্ধারণী আলোচনার কেন্দ্র তৈরি হবে।
৩. ধাপে ধাপে আইন সংশোধন ও প্রচারণা
জনসচেতনতা, রাজনৈতিক সমঝোতা ও সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে ধাপে ধাপে এই পদ্ধতির পথ প্রস্তুত করা সম্ভব।
পিআর পদ্ধতি নিঃসন্দেহে একটি গণতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা, যেখানে সব দলের ভোটের প্রতিফলন ঘটে। তবে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক বাস্তবতায় একে এখনই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ।
কিন্তু সঠিক প্রস্তুতি, রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি ও জনগণের সচেতন অংশগ্রহণের মাধ্যমে ধাপে ধাপে এই পদ্ধতির দিকে যাওয়া সম্ভব। এটি না শুধু ভোটের মূল্যায়ন নিশ্চিত করবে, বরং ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের ভিতও শক্তিশালী করবে।
FAQs:
Q1: পিআর পদ্ধতি কী?
উত্তর: পিআর বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন পদ্ধতিতে, একটি দল নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পায়, তারা তত শতাংশ আসন সংসদে পায়। এতে প্রতিটি ভোটের মূল্যায়ন হয়।
Q2: পিআর পদ্ধতির সুবিধা কী?
উত্তর: এই পদ্ধতিতে ছোট দলগুলোরও সংসদে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে, ভোটের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে এবং দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সহনশীলতা বাড়ে।
Q3: বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতি চালু সম্ভব?
উত্তর: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক বাস্তবতায় এখনই পিআর পদ্ধতি চালু করা ঝুঁকিপূর্ণ। তবে ধাপে ধাপে স্থানীয় সরকার বা উচ্চকক্ষে পরীক্ষামূলকভাবে এটি চালু করা যেতে পারে।
Q4: কেন অনেকে পিআর পদ্ধতির বিরোধিতা করছে?
উত্তর: বিরোধীরা মনে করে এতে সরকার দুর্বল হবে, সিদ্ধান্তে অনৈক্য দেখা দেবে এবং রাজনৈতিকভাবে বড় দলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
Q5: পিআর পদ্ধতিতে কি স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অংশ নিতে পারবে?
উত্তর: না, এই পদ্ধতিতে ভোট দলকে দেওয়া হয়। ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ প্রায় নেই।
মো: রাজিব আলী/
আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ
- এসএসসি রেজাল্ট ২০২৫: ফল প্রকাশের তারিখ ঘোষণা, জানুন দেখার নিয়ম
- এসএসসি রেজাল্ট ২০২৫: কিভাবে সবার আগে দেখবেন আপনার ফল? জানুন নিয়ম
- SSC Result 2025: দুপুর ২টায় প্রকাশ, কীভাবে দেখবেন ফলাফল
- আজ এসএসসি রেজাল্ট ২০২৫ প্রকাশ: দ্রুত অনলাইনে ফল দেখার সহজ উপায়
- বাংলাদেশ বনাম তুর্কমেনিস্তান: গোল বন্যা, ৯০ মিনিটের খেলা শেষ
- বাংলাদেশ বনাম তুর্কমেনিস্তান: আজ নতুন সময়ে শুরু হবে ম্যাচ, জেনে নিন সূচি
- এসএসসি রেজাল্ট ২০২৫: অনলাইনে ও এসএমএসে দেখবেন যেভাবে
- চেলসি বনাম ফ্লুমিনেন্স: সেমিফাইনালে জমজমাট ৯০ মিনিট শেষ, ফাইনালে কার জায়গা?
- বাংলাদেশ বনাম তুর্কমেনিস্তান: ৭ গোলে শেষ হলো প্রথমার্ধ
- এসএসসির ফল পুনর্নিরীক্ষার তারিখ ঘোষণা: ‘বোর্ড চ্যালেঞ্জ’ করবেন যেভাবে
- বিনিয়োগকারীদের জন্য ১২ কোম্পানির লভ্যাংশ ঘোষণা
- রাতে পিএসজি বনাম রিয়াল মাদ্রিদ ম্যাচ: বাংলাদেশ থেকে লাইভ দেখার সহজ উপায়
- আল-হিলাল বনাম ফ্লুমিনেন্স: নাটকীয়ভাবে শেষ হলো কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ
- বাংলাদেশ বনাম তুর্কমেনিস্তান: ম্যাচ প্রিভিউ, পরিসংখ্যান ও ম্যাচ শুরুর সময়
- চেলসি বনাম পালমেইরাস কোয়ার্টার-ফাইনাল: ১-০ গোলে প্রথমার্ধ শেষ