ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১৩ ভাদ্র ১৪৩২

মা হচ্ছেন? জেনে নিন স্বাস্থ্যকর গর্ভাবস্থার ৯ গুরুত্বপূর্ণ ধাপ

স্বাস্থ্য ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ আগস্ট ২৮ ০৯:৪৮:৫১
মা হচ্ছেন? জেনে নিন স্বাস্থ্যকর গর্ভাবস্থার ৯ গুরুত্বপূর্ণ ধাপ

নিজস্ব প্রতিবেদক: গর্ভধারণের আগে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তুতি গ্রহণ করলে শিশুরা জন্মগত ত্রুটি এবং প্রসব-পরবর্তী নানা জটিলতার ঝুঁকি থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে সুরক্ষিত থাকতে পারে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক ভিডিওতে, সহায়ক হেলথ-এর প্রধান মেডিকেল অফিসার ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা ড. তাসনিম জারা গর্ভধারণের পরিকল্পনাকারী নারীদের জন্য নয়টি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতির কথা তুলে ধরেছেন, যা মা ও শিশুর সুস্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য।

১. আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট: অপরিহার্য পুষ্টি

ড. জারা জোর দিয়ে বলেছেন যে গর্ভকালীন সময়ে মায়ের শরীরে পর্যাপ্ত আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড থাকা অত্যন্ত জরুরি। আয়রনের ঘাটতি শিশুর কম ওজন ও সময়ের আগে প্রসবের কারণ হতে পারে। অন্যদিকে, ফলিক অ্যাসিডের অভাব শিশুর মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডে গুরুতর জন্মগত ত্রুটি সৃষ্টি করতে পারে। এসব ঝুঁকি এড়াতে গর্ভধারণের চেষ্টা শুরু করার পর থেকেই প্রতিদিন আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট সেবন করা উচিত। সাধারণত ফার্মেসিতে ০.৫ মিলিগ্রাম ফলিক অ্যাসিডযুক্ত ট্যাবলেট পাওয়া যায়। তবে, যাদের ওজন বেশি, ডায়াবেটিস আছে, নির্দিষ্ট খিঁচুনির ঔষধ চলছে, অথবা পরিবারে মস্তিষ্ক বা মেরুদণ্ডের জন্মগত ত্রুটির ইতিহাস আছে, তাদের ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার ফলিক অ্যাসিড প্রয়োজন হতে পারে এবং এ বিষয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক। পর্যাপ্ত আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড নিশ্চিত করতে ডাক্তারের পরামর্শে গর্ভকালীন মাল্টিভিটামিনও গ্রহণ করা যেতে পারে।

২. টিকাদান: মা ও শিশুর সুরক্ষায় ঢাল

গর্ভধারণের আগে প্রয়োজনীয় সকল টিকা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ড. জারা হাম-রুবেলা (MMR) টিকার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। শৈশবে যদি হাম-রুবেলার দুটি ডোজ গ্রহণ করা না হয়ে থাকে, তবে গর্ভের শিশুর রুবেলায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এর ফলে শিশুর চোখ, কান, হৃদপিণ্ড ও মস্তিষ্কে গুরুতর জন্মগত ত্রুটি এমনকি গর্ভপাতও হতে পারে। যেহেতু গর্ভাবস্থায় এই টিকা দেওয়া যায় না, তাই গর্ভধারণের পরিকল্পনার এক মাস আগেই এটি গ্রহণ করতে হবে। যারা শৈশবের টিকাদান সম্পর্কে নিশ্চিত নন, তারা রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে পূর্বে টিকা নেওয়া হয়েছে কিনা তা জানতে পারবেন। এছাড়া, টিটেনাস টিকাও অনেকের ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ থাকতে পারে, যা গর্ভাবস্থাতেও নেওয়া যায়, তবে এ বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণীয়। হেপাটাইটিস বি টিকাও একটি গুরুত্বপূর্ণ টিকাদান, যা সম্পূর্ণ করতে কয়েক মাস সময় লাগে (মোট তিনটি ডোজ)। গর্ভাবস্থায় হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মা মারাত্মক অসুস্থ হতে পারেন এবং ভাইরাসটি শিশুর মধ্যেও সংক্রমিত হতে পারে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ২০০৩ সালের আগে যাদের জন্ম হয়েছে, তারা সম্ভবত শৈশবে এই টিকা পাননি, কারণ ২০০৩ সাল থেকে এটি জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়। টিকা গ্রহণের আগে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন কিনা তা জেনে নেওয়া উচিত।

৩. ক্যাফেইন: গর্ভকালীন সময়ে বর্জনীয়

গর্ভাবস্থায় ক্যাফেইন সেবন শিশুর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যাফেইনযুক্ত খাবার ও পানীয় গ্রহণের সাথে শিশুর কম ওজন, গর্ভপাত এবং মৃত শিশু প্রসবের যোগসূত্র রয়েছে। চা, কফি, কোমল পানীয় (যেমন কোক, পেপসি, মাউন্টেন ডিউ), এনার্জি ড্রিংকস এবং চকলেটসহ ক্যাফেইনযুক্ত সকল খাবার ও পানীয় গর্ভাবস্থায় সতর্কতার সাথে এড়িয়ে চলতে হবে। গর্ভধারণের পরিকল্পনা করার সময় থেকেই ধীরে ধীরে ক্যাফেইন গ্রহণ কমিয়ে আনা এবং পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া উত্তম, কারণ গর্ভধারণের সাথে সাথেই তো আর আপনি জানতে পারবেন না।

৪. ভিটামিন ডি: সুস্থ বিকাশের চাবিকাঠি

গর্ভের শিশুর হাড়, দাঁত এবং অন্যান্য অঙ্গের সুস্থ গঠনের জন্য ভিটামিন ডি অপরিহার্য। তবে, আমাদের দেশে অনেক নারীর শরীরেই ভিটামিন ডি-এর অভাব রয়েছে। ২০১১-১২ সালের এক জাতীয় জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রতি চারজন নারীর মধ্যে একজনের ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি রয়েছে। যদিও সূর্যের আলো ভিটামিন ডি উৎপাদনের প্রধান উৎস, তবে কর্মব্যস্ততা বা পোশাকের কারণে অনেকেরই পর্যাপ্ত সূর্যালোক গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি আছে কিনা তা একজন চিকিৎসকের পরামর্শে পরীক্ষা করে নেওয়া এবং প্রয়োজনীয় মাত্রায় ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা উচিত।

৫. ওজন নিয়ন্ত্রণ: স্বাভাবিক ওজন জরুরি

গর্ভধারণের আগে স্বাভাবিক ওজন বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। অতিরিক্ত ওজন উচ্চ রক্তচাপ, প্রি-এক্লাম্পশিয়া, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, প্রসবকালীন জটিলতা যেমন শিশুর কাঁধ আটকে যাওয়া, অতিরিক্ত রক্তপাত বা সিজারিয়ান অপারেশনের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। অন্যদিকে, স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজন অকাল প্রসব বা কম ওজনের শিশু জন্মের কারণ হতে পারে। যদিও এই সমস্যাগুলো স্বাভাবিক ওজনের নারীদের ক্ষেত্রেও দেখা দিতে পারে, তবে অস্বাভাবিক ওজন এই ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করার সময় ওজন পরীক্ষা করে স্বাভাবিক ওজন নিশ্চিত করা উচিত। তবে, গর্ভাবস্থায় কোনোভাবেই ওজন কমানোর চেষ্টা করা যাবে না।

৬. সুষম খাবার: মা ও শিশুর পুষ্টি

সুষম খাদ্যাভ্যাস সব সময়ই স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, তবে গর্ভধারণের পরিকল্পনার সময় এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্লেটে ভাত বেশি না নিয়ে, প্রথমে শাক-সবজি ও ফল দিয়ে প্লেটের অর্ধেক পূর্ণ করার চেষ্টা করুন। প্লেটের এক-চতুর্থাংশ আমিষ জাতীয় খাবার যেমন মাছ, মুরগির মাংস, ডাল, ডিম এবং বাকি এক-চতুর্থাংশ ভাত বা রুটি রাখুন। সাদা চাল ও সাদা আটার পরিবর্তে লাল চাল ও লাল আটা ব্যবহার করা অধিক স্বাস্থ্যকর। রান্নার সময় মসলা, লবণ ও তেল সীমিত পরিমাণে ব্যবহার করুন। প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফাস্ট ফুড এবং অতিরিক্ত চিনি, লবণ ও চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন, কারণ এসব খাবারে সাধারণত বাড়িতে রান্না করা খাবারের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অস্বাস্থ্যকর উপাদান থাকে।

৭. ব্যায়াম: শারীরিক প্রস্তুতির জন্য

গর্ভধারণ এবং সন্তান প্রসব একটি দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য প্রক্রিয়া। ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরকে এই ধকলের জন্য প্রস্তুত করা যায় এবং এর অনেক উপকারিতা রয়েছে। নিয়মিত ব্যায়াম গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়াতে পারে, প্রি-এক্লাম্পশিয়া ও গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের মতো রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে। এছাড়া, গর্ভাবস্থায় যে মানসিক চাপ বা অস্থিরতা দেখা দিতে পারে, তা কমাতেও ব্যায়াম সাহায্য করে।

৮. ধূমপান: সম্পূর্ণ বর্জনীয়

ধূমপান, সেবন করা বা এর আশেপাশে থাকা নারী ও পুরুষ উভয়েরই সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। গর্ভবতী মায়ের আশেপাশে কেউ ধূমপান করলে, জন্মকালে শিশুর ওজন ২০ শতাংশ কম হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই, গর্ভধারণের পরিকল্পনা করার সময় থেকে ধূমপান সম্পূর্ণ বর্জন করা উচিত এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করা উচিত।

৯. রোগ নিয়ন্ত্রণ: সুস্থতার পূর্বশর্ত

গর্ভধারণের পরিকল্পনা করার আগে একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা অত্যন্ত উপকারী। ডাক্তার আপনার সার্বিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে থাইরয়েডের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, খিঁচুনি, ডায়াবেটিসের মতো কোনো রোগ আছে কিনা তা নির্ণয় করতে পারবেন এবং সেগুলো কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় সে বিষয়ে সঠিক পরামর্শ দিতে পারবেন। বর্তমানে কোনো ঔষধ সেবন করলে, গর্ভধারণের আগে তাতে কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে কিনা তাও তিনি জানাবেন। পরিবারের কোনো সদস্যের কী কী রোগ আছে এবং পূর্ববর্তী গর্ভধারণে কোনো জটিলতা ছিল কিনা, এসব বিষয়ও আলোচনা করা উচিত, যা ডাক্তারকে আপনার পরিস্থিতি অনুযায়ী সঠিক পরামর্শ দিতে সাহায্য করবে। মনে কোনো প্রশ্ন থাকলে তা নিঃসঙ্কোচে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করুন।

মো: রাজিব আলী/

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ