ঢাকা, শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

জমি দলিল লেখার সময় ১১টি আইনগত বিষয় অবশ্যই যাচাই করুন

জাতীয় ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ জুলাই ১২ ১০:১০:০৩
জমি দলিল লেখার সময় ১১টি আইনগত বিষয় অবশ্যই যাচাই করুন

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশে জমি সংক্রান্ত বিরোধ ও জটিলতা প্রতিদিন বাড়ছে। বিচার বিভাগের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বিচারাধীন মামলার প্রায় ৬০ শতাংশই জমিজমা সংশ্লিষ্ট। এর একটি বড় অংশই শুরু হয় জমির দলিলে ভুল, অসঙ্গতি বা ত্রুটির কারণে। অথচ, এসব ভুল খুব সহজেই এড়ানো সম্ভব—যদি দলিল লেখার সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখা হয়।

দলিল শুধু একটি কাগজ নয়, এটি আইনি মালিকানার দলিল, যা আপনার জমির ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার ভিত্তি তৈরি করে। সুতরাং দলিল লেখার কাজটি হতে হবে অত্যন্ত যত্নসহকারে, আইনি জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে।

এখানে তুলে ধরা হলো দলিল লেখার সময় ১১টি এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেগুলো খেয়াল না রাখলে আপনি ভবিষ্যতে বড় ধরনের আইনি সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন।

১. দলিল দাতার (বিক্রেতার) আইনি যোগ্যতা যাচাই করুন

দলিল লেখার আগে নিশ্চিত হতে হবে বিক্রেতা আইনগতভাবে দলিল সম্পাদনের যোগ্য কিনা। বিক্রেতা যদি সাবালক না হন, বা মানসিকভাবে অক্ষম হন, কিংবা জমির উপর তাঁর পূর্ণ মালিকানা না থাকে—তবে এমন দলিল ভবিষ্যতে বাতিল হয়ে যেতে পারে। তাই, দলিল লেখার পূর্বে বিক্রেতার জাতীয় পরিচয়পত্র, উত্তরাধিকার কাগজপত্র এবং প্রয়োজনীয় নথিপত্র ভালোভাবে যাচাই করুন।

২. পূর্বের দলিল ও বর্তমান খসড়ার মধ্যে মিল আছে কিনা তা নিশ্চিত করুন

অনেক সময় পুরাতন দলিল থেকে নতুন দলিল তৈরি করার সময় কিছু তথ্য বাদ পড়ে যায় বা ভুল হয়। যেমন দাগ নম্বর, মৌজার নাম, পূর্বের দলিল নম্বর ইত্যাদি। তাই পুরাতন দলিলের সঙ্গে হুবহু মিল রেখে সব তথ্য লিখতে হবে। ভুলে গেলে বা অনুমান করে কিছু লিখলে তা ভবিষ্যতে বিপদের কারণ হতে পারে।

৩. পক্ষদের পূর্ণ পরিচয় বিস্তারিতভাবে লিখুন

ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের পূর্ণ নাম, পিতার নাম, পেশা, ধর্ম, স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা দলিলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। কোন পক্ষ কোন ভূমিকা পালন করছে তা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করতে হবে—যেমন: প্রথম পক্ষ (বিক্রেতা), দ্বিতীয় পক্ষ (ক্রেতা)।

৪. উত্তরাধিকার সম্পর্ক থাকলে তার প্রমাণপত্র নিশ্চিত করুন

জমি যদি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়, তবে বিক্রেতার সঙ্গে পূর্ব মালিকের সম্পর্ক সঠিকভাবে দলিলে উল্লেখ করতে হবে। ভুল বা ভুয়া উত্তরাধিকার তথ্য ভবিষ্যতে জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ তৈরি করতে পারে।

৫. জমির সঠিক তফসিল দলিলে সংযুক্ত করুন

জমির অবস্থান স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। এর মধ্যে থাকবে: জেলা, উপজেলা, রেজিস্ট্রি অফিসের নাম, মৌজার নাম, দাগ নম্বর, খতিয়ান নম্বর, জমির শ্রেণি (ভিটা, ডাঙ্গা, জলাভূমি ইত্যাদি)। জমির পরিমাণও নির্ভুলভাবে লিখতে হবে—শতাংশ বা একরের হিসেবে।

৬. চৌহদ্দি নির্ভুল ও পরিষ্কারভাবে লিখুন

জমির চারপাশে কার জমি আছে, কোন দিকে কোন মালিক—তা সঠিকভাবে লিখতে হবে। যেমন: পূর্বে অমুকের জমি, পশ্চিমে সরকারি রাস্তা ইত্যাদি। এতে জমির অবস্থান নির্ধারণ সহজ হয় এবং ভবিষ্যতে সীমানা সংক্রান্ত মামলা প্রতিরোধ করা যায়।

৭. দলিলের প্রতিটি পৃষ্ঠায় বিক্রেতার স্বাক্ষর বা টিপ সহি নিশ্চিত করুন

প্রতিটি পৃষ্ঠায় দলিল দাতার স্বাক্ষর থাকা উচিত। নিরক্ষর হলে টিপ সহি দিতে হবে। প্রথম পৃষ্ঠার উপরের ডান কোণে এবং শেষ পৃষ্ঠার নিচে এই স্বাক্ষর বা টিপ সহি থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৮. সাক্ষী ও সনাক্তকারী নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি হতে হবে

কমপক্ষে দুইজন সাক্ষী ও একজন সনাক্তকারীর স্বাক্ষর দলিলে থাকতে হবে। এদের নাম, পিতার নাম ও ঠিকানাও দলিলে উল্লেখ করতে হবে। সাক্ষী যদি পরে অস্বীকার করেন, তাহলে দলিলের বৈধতা হুমকির মুখে পড়তে পারে।

৯. কোনো কাটাকাটি বা ঘষামাঝা থাকলে কৈফিয়ত লিখে স্বাক্ষর করুন

যদি দলিল লেখার সময় কোনো শব্দ কাটা হয় বা ভুল সংশোধন করতে হয়, তবে তা শেষ পৃষ্ঠায় কৈফিয়ত হিসেবে উল্লেখ করে দলিল লেখকের স্বাক্ষর সহ লিখে দিতে হবে। এতে দলিল ভবিষ্যতে অস্বীকারযোগ্য হয়ে পড়ে না।

১০. দাগভিত্তিক জমির পরিমাণ আলাদা করে লিখুন

যদি একাধিক দাগের জমি থাকে, তবে প্রতিটি দাগ অনুযায়ী জমির পরিমাণ লিখুন। কয়েকটি দাগের জমি যোগ করে একটি মোট পরিমাণ লিখে ফেললে তাতে বিভ্রান্তির সুযোগ থাকে। প্রতিটি দাগের জমি কতটুকু হস্তান্তর করা হচ্ছে তা স্পষ্ট করুন।

১১. খতিয়ান ও দাগ নম্বর যাচাই করে নিন

জমি সংক্রান্ত ভুলের সবচেয়ে সাধারণ উৎস হল দাগ ও খতিয়ান নম্বরের ভুল। তাই দলিল লেখার আগে সংশ্লিষ্ট তহসিল অফিস থেকে জমির আপডেট খতিয়ান সংগ্রহ করুন এবং যাচাই করে দলিল লিখুন।

জমি হলো আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদগুলোর একটি। আর এই সম্পদের আইনগত মালিকানা নির্ভর করে একটি দলিলের ওপর। তাই দলিল লেখার সময় ছোট ছোট বিষয়েও গাফিলতি করা উচিত নয়। ওপরের ১১টি বিষয় যত্ন সহকারে খেয়াল রাখলে ভবিষ্যতে জমিজমা সংক্রান্ত জটিলতা অনেকটাই এড়িয়ে চলা সম্ভব।

দলিল লেখাকে হালকা করে দেখবেন না। দক্ষ ও তালিকাভুক্ত দলিল লেখকের সাহায্য নিন, নিজে যাচাই করুন, ও প্রয়োজনে আইনজীবীর পরামর্শ নিন। কারণ, একটি ভুল দলিলের খেসারত হতে পারে একটি জীবনের কষ্টার্জিত সম্পদ হারানো।

FAQ (প্রশ্নোত্তর):

প্রশ্ন ১: দলিল লেখার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কোনটি?

উত্তর: বিক্রেতার মালিকানা যাচাই এবং জমির সঠিক দাগ-খতিয়ান উল্লেখ করাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন ২: দলিলে ভুল থাকলে কী সমস্যা হতে পারে?

উত্তর: ভুল দলিল ভবিষ্যতে মালিকানা বিরোধ, মামলা বা জমি হারানোর ঝুঁকি সৃষ্টি করে।

প্রশ্ন ৩: দলিল লেখার সময় কয়জন সাক্ষী লাগে?

উত্তর: কমপক্ষে ২ জন সাক্ষী ও ১ জন সনাক্তকারীর স্বাক্ষর আবশ্যক।

প্রশ্ন ৪: দলিলে ঘষামাঝা থাকলে কী করতে হবে?

উত্তর: দলিলের শেষাংশে কৈফিয়ত দিয়ে দলিল লেখকের স্বাক্ষরসহ উল্লেখ করতে হবে।

প্রশ্ন ৫: দলিল লেখার আগে কাদের পরামর্শ নেওয়া উচিত?

উত্তর: অভিজ্ঞ দলিল লেখক ও প্রয়োজনে আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া উচিত।

মো: রাজিব আলী/

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ