ঢাকা, রবিবার, ২৫ মে ২০২৫, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

পুঁজিবাজারে সমন্বয়ের অভাবেই দীর্ঘস্থায়ী সংকট

শেয়ারবাজার ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ মে ২৪ ১২:৫৫:২০
পুঁজিবাজারে সমন্বয়ের অভাবেই দীর্ঘস্থায়ী সংকট

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের পুঁজিবাজার দীর্ঘদিন ধরেই অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা, সরকারের পরিবর্তনের পর বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে, কিন্তু বাস্তবতা হলো—দরপতনের ধারাবাহিকতা বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরও দুর্বল করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বাজার সংশ্লিষ্টরা পুঁজিবাজারের সংস্কার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।

বিনিয়োগ হারিয়ে ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা

গত কয়েক মাসে বাজারে লাগাতার দরপতনের ফলে অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন, এমনকি স্ট্রোক করে মৃত্যুবরণ করার ঘটনাও ঘটেছে। প্রতিবাদ জানাতে বিনিয়োগকারীরা মতিঝিলে কফিন নিয়ে বিক্ষোভও করেছেন, যেখানে বিএসইসি চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবি তুলেছেন।

বিএসইসির ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির ভূমিকা নিয়েও তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ মনে করেন, চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের অধীনে বাজারে আস্থার সংকট চরমে পৌঁছেছে। তবে সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী এবং বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এসএম ইকবাল হোসেন দু’জনই মনে করেন, শুধু একজন চেয়ারম্যানের পরিবর্তনেই পুঁজিবাজার ভালো হয়ে যাবে—এমন ভাবনা অবাস্তব। বরং এর পেছনে বহুদিনের গাফিলতি, নীতিগত দুর্বলতা ও কাঠামোগত সমস্যা দায়ী।

সংকটের গভীরে যে সমস্যাগুলো

বিশেষজ্ঞ ও বাজারসংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমান সংকট মূলত বহু বছর ধরে জমে থাকা সমস্যার প্রতিফলন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

কারসাজি ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর দৌরাত্ম্য: কিছু গোষ্ঠী কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের ঠকায়।

রিয়েলটাইম নজরদারির ঘাটতি: আধুনিক প্রযুক্তি ও মনিটরিংয়ের অভাবে কারসাজিকারীরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।

আইপিও অনুমোদনে গাফিলতি: দুর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানিকে আইপিও অনুমোদনের ফলে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহ: রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরও নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানগুলো।

আস্থার সংকট: ২০১০ সালের ধসের পর থেকেই অনেক বিনিয়োগকারী বাজারে আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন।

নীতিগত দুর্বলতা ও নতুন পণ্যের অভাব: বন্ড, ডেরিভেটিভস, ETF—এইসব পণ্যের সঠিক উন্নয়ন হয়নি।

সরকারের নির্দেশনা: পাঁচ দফা সংস্কার উদ্যোগ

বিনিয়োগকারীদের দাবির প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি পুঁজিবাজার নিয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন, যা বাস্তবায়িত হলে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে পারে। নির্দেশনাগুলো হলো:

সরকারি মালিকানাধীন বহুজাতিক কোম্পানিকে বাজারে তালিকাভুক্ত করা।

বেসরকারি বড় কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনতে প্রণোদনা ও সহায়তা।

বিদেশি বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে তিন মাসের মধ্যে পুঁজিবাজার সংস্কার।

অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা।

ব্যাংক নির্ভরতা কমিয়ে বন্ড ও ইক্যুইটির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহে উৎসাহ।

বর্তমান অবস্থার মূল্যায়ন

বর্তমানে দেশে ডলার স্থিতিশীল, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বেড়েছে এবং ব্যাংকিং খাতে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরেছে। কিন্তু পুঁজিবাজার এখনো সেই উন্নয়নের ছোঁয়া পায়নি। বরং লেনদেন নেমে এসেছে তলানিতে, সূচক কমেছে হাজার পয়েন্টেরও বেশি, বাজারমূলধন উড়ে গেছে লাখ কোটি টাকার ওপরে। ফলে পুঁজিবাজার এখন অর্থনীতির জন্য একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সমাধানের পথ কী?

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাতারাতি কোনো ম্যাজিক সলিউশন নেই। তবে কিছু সমন্বিত ও কার্যকরী পদক্ষেপ দ্রুত নিতে হবে:

বিএসইসিকে স্বাধীনভাবে, কিন্তু দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে দিতে হবে।

বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে—স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে।

প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারির ব্যবস্থাপনায় দ্রুত সংস্কার আনতে হবে।

করনীতি পুনর্বিন্যাস করে ভালো কোম্পানিকে বাজারমুখী করতে হবে।

বাজারে নতুন পণ্য ও সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট গড়ে তুলতে হবে।

আইপিও প্রক্রিয়ায় কঠোর স্ক্রুটিনি নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এক সময় ছিল দেশের অর্থনীতির সম্ভাবনাময় খাত। কিন্তু দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, কারসাজি, আস্থার অভাব ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এ খাতকে ক্রমেই দুর্বল করে দিয়েছে। এখন সময় এসেছে, সমন্বিত সংস্কারের মাধ্যমে পুঁজিবাজারকে ঘুরে দাঁড় করানোর। সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও তা বাস্তবায়নে দৃঢ় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ প্রয়োজন। সময়ক্ষেপণ হলে আস্থা ফেরানো আরও কঠিন হয়ে যাবে।

মো: রাজিব আলী/

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ