ঢাকা, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২

শেখ হাসিনার নির্দেশে লেথাল উইপন ব্যবহারে আবু সাঈদ নিহত

রাজনীতি ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ জুলাই ০১ ১২:৪৪:০৪
শেখ হাসিনার নির্দেশে লেথাল উইপন ব্যবহারে আবু সাঈদ নিহত

নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০১৩ সালের গরম জুলাইয়ের একটি দুপুর। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ইংরেজি বিভাগের নিরীহ এক ছাত্র, আবু সাঈদ, হাতে মাত্র একটি লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কে। দেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি নতুন সূর্যোদয়ের আশা নিয়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মতো আবু সাঈদও ছিলেন যুবস্বপ্নের বাহক। কিন্তু সেই দিনটি ছিল তার জীবনের শেষ দিন। নিরস্ত্র অবস্থায় পুলিশের গুলিতে জীবন হারান আবু সাঈদ। সেইদিন থেকেই শুরু হয় দেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বর অধ্যায়ের পাতা মোড়ার যাত্রা।

আজ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ সেই কালো অধ্যায়ের দায়ীদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। অভিযোগের শীর্ষে রয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি সরাসরি এই হত্যাকাণ্ডের ‘সুপিরিয়র কমান্ডার’ হিসেবে দায়ী। অভিযোগপত্রে উঠে এসেছে কিভাবে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজিপি এবং তাদের অধীনস্থ কমান্ডাররা এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে একযোগে কাজ করেছেন।

হত্যার পরিকল্পনা ও আদেশ: ক্ষমতার ছায়ায় নির্মম এক হত্যা

আবু সাঈদের হত্যার নির্দেশ দেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. হাসিবুর রশীদ বাচ্চু, রংপুর মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান, সাবেক উপকমিশনার (অপরাধ) মো. আবু মারুফ হোসেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম। তারা নিজেদের ঊর্ধ্বতন অবস্থান থেকে যৌথভাবে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দেন প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারী ছাত্রদের দমন করার।

চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানান, “শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে পুলিশের সর্বোচ্চ কমান্ড থেকে শুরু করে নিচু স্তর পর্যন্ত লেথাল উইপন ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।” আদেশটি পৌঁছায় পুলিশের প্রতিটি ইউনিটে, যা বাস্তবায়ন হয় নির্মমভাবে।

হত্যাকাণ্ডের দিন: নিরীহ ছাত্রের মৃত্যু, আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ

১৬ জুলাই ২০১৩। আবু সাঈদ হাতে মাত্র একটি লাঠি নিয়ে প্রতিবাদ করছিলেন। কিন্তু পুলিশের গুলিতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। গুলির আওয়াজে চারজন আন্দোলনকারীও আহত হন। ওই সময়ের ভিডিও ফুটেজ, সিসিটিভি, সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টে স্পষ্ট দেখা যায় কীভাবে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়েছিল।

এই হত্যাকাণ্ড সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সারা দেশে ছাত্র-জনতা ও সাধারণ মানুষ প্রতিবাদের ঢেউ তুলে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম থেকে শহর, কারখানা থেকে অফিস, সবখানে। আগামীদিনের গণতন্ত্র রক্ষার নামে শুরু হয় ‘কমপ্লিট শাটডাউন’।

৫ আগস্ট ২০১৩-এ দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বৈরাচারী সরকার পতনের মাধ্যমে আবু সাঈদের মৃত্যুর নিন্দায় জনতার অভিব্যক্তি আরও প্রবল হয়।

হত্যাকাণ্ডের দিক পরিবর্তন ও ষড়যন্ত্র: সুরতহাল থেকে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন

আসামিরা হত্যাকাণ্ডকে অন্য পথে প্রবাহিত করার জন্য সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পরিবর্তন করার চেষ্টা চালায়। আদালত সূত্রে জানা গেছে, তারা নানা কৌশলে এসব দস্তাবেজ বদলে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন, যাতে মূল অপরাধ ঢেকে যায়। কিন্তু তদন্ত সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর তৎপরতায় এসব ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যায়।

মামলার বর্তমান অবস্থান: ৩০ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ সোমবার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়। এতে ৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে, যার মধ্যে চারজন ইতোমধ্যে গ্রেফতার। বাকিদের মধ্যে ২৬ জন পলাতক থাকায় তাদের গ্রেফতার ও আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, “বিচারের জন্য যতটুকু সময় প্রয়োজন, আমরা সেই গতিতেই কাজ করছি। তাড়াহুড়া নয়, কিন্তু দ্রুততম সময়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করা হবে।”

আগামী ১০ জুলাই মামলার পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

সুপিরিয়র দায়: ক্ষমতাসীন থেকে প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে পুলিশ

অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, শুধু শেখ হাসিনা বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রশাসন, পুলিশ—from উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা মিলেমিশে হত্যাকাণ্ড এবং আন্দোলন দমন করেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে বিএনপি-আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশনাও। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়, এটা একটি সংগঠিত ও সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে নতুন অধ্যায়

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হওয়ায় দেশের গণতন্ত্রপ্রেমী সমাজে আশা জাগেছে—ন্যায়বিচার আসবে, ক্ষমতাশীলদের স্বেচ্ছাচারিতা আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না।

চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বললেন, “আমরা একদিনও বেশি সময় নিচ্ছি না। বিচার হবে দ্রুত, নিরপেক্ষ ও ন্যায়সঙ্গত। আর যারা অপরাধে লিপ্ত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

২০১৩ সালের ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে লেথাল অস্ত্র দিয়ে হত্যা করার ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। ৩০ জন আসামির মধ্যে চারজন গ্রেফতার, বাকি পলাতক। ১০ জুলাই মামলার পরবর্তী শুনানি। বিচার প্রক্রিয়া দ্রুততম সময়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় এগোচ্ছে।

আল-আমিন ইসলাম/

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ