ঢাকা, রবিবার, ৪ মে ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২

পেপ্যাল কি আসলেই আসছে দেশে, সরকারের পদক্ষেপ

জাতীয় ডেস্ক . ২৪আপডেট নিউজ
২০২৫ মে ০৪ ১২:৫৩:২৪
পেপ্যাল কি আসলেই আসছে দেশে, সরকারের পদক্ষেপ

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশে পেপ্যাল চালুর আলোচনা যেন এক দীর্ঘ অধ্যায়ের নাম। বছর বছর নানা প্রতিশ্রুতি, উচ্চপর্যায়ের বৈঠক ও সরকারি ঘোষণার পরও এখনও পেপ্যাল চালু হয়নি। তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর এই আন্তর্জাতিক লেনদেন সেবা আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। বিশেষ করে ফ্রিল্যান্সিং পেশায় যুক্ত তরুণদের মধ্যে আবার নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে।

গত ৫ আগস্টের পর দেশে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে। এরপর থেকেই বিভিন্ন মহলে আবার জোরেশোরে আলোচনায় আসে পেপ্যালের সম্ভাব্য আগমন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সরকার এবার ব্যাপারটিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে এবং কূটনৈতিক পর্যায়েও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

সরকারের পক্ষ থেকে কী বলা হচ্ছে?

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানিয়েছেন, এখনও দৃশ্যমান কোনো আপডেট নেই। তবে মন্ত্রণালয় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মার্চ মাসে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আগের সরকার নাগরিকদের পেপ্যাল নিয়ে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছে। তারা বহুবার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছে, কিন্তু বাস্তব অগ্রগতি ছিল না।”

তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশে পেপ্যাল না আসার কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটি বড় কারণ হলো—আমাদের দেশে ২৪ ঘণ্টা ফাইন্যান্সিয়াল স্ক্যাম মোকাবিলার সক্ষমতা নেই। স্ক্যাম হলে তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করার মতো ইউনিট বা কল সেন্টার আমাদের নেই। এছাড়া ঠিকানা যাচাইকরণের বিষয়েও ঘাটতি রয়েছে।”

পেপ্যাল শুধু পেমেন্ট গেটওয়ে নয়

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেন—পেপ্যাল একটি মার্কেটপ্লেসও, শুধু পেমেন্ট গেটওয়ে নয়। অর্থাৎ এখানে লেনদেন হতে হয় দ্বিমুখী। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র একমুখী লেনদেনের অনুমোদন দিয়ে আসছে। ফলে পেপ্যালের নীতিমালার সঙ্গে মিল থাকছে না। তিনি বলেন, “পেপ্যালের প্রতি অনুরোধ জানানো হলে বিষয়টি প্রায়শই ভারতের কাছে চলে যায়। পেপ্যালের সিঙ্গাপুর অফিসেও ভারতীয় কর্মকর্তাদের আধিপত্য রয়েছে, যারা মাঝে মাঝে বাধা তৈরি করে।”

কী বলছেন ফ্রিল্যান্সাররা?

ঢাকার একজন অভিজ্ঞ ফ্রিল্যান্সার তৌহিদুর রহমান বলেন, “আমরা তো ৭-৮ বছর ধরে শুনে আসছি, পেপ্যাল আসবে। শেষ পর্যন্ত আসেনি। এবার যদি সত্যি আসে, তাহলে আমাদের কাজের গতি দ্বিগুণ হবে।”

একই রকম অনুভূতি প্রকাশ করেছেন টাঙ্গাইলের মধুপুরের ফ্রিল্যান্সার সুবীর নকরেক। তিনি বলেন, “ফ্রিল্যান্সার, উদ্যোক্তা ও ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের জন্য পেপ্যাল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এখন আমরা বিকল্প পদ্ধতি যেমন স্ক্রিল, পেওনিয়ার কিংবা ওয়াইজের ওপর নির্ভর করি। এতে সময় ও খরচ দুটোই বেশি হয়।”

অতীতের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতা

২০১৬ সালের ১৫ জুলাই সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একটি চুক্তির মধ্য দিয়ে পেপ্যাল চালুর কথা বলা হয়। বলা হয়েছিল, প্রবাসী আয় ও ফ্রিল্যান্সারদের আয় সহজে দেশে আনার সুযোগ তৈরি হবে। এরপর ২০১৭ সালের ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড মেলায় ‘পেপ্যাল’ চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়, যা পরে দেখা যায় শুধুমাত্র তাদের রেমিট্যান্স সেবা ‘জুম’ ছিল। এটি দিয়ে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র থেকে টাকা পাঠানো যেত।

২০২১ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেছিলেন, ডিসেম্বরে পেপ্যাল চালু হবে। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক তখন পেপ্যাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে বলেও জানান। কিন্তু বছরের শেষে এসে কোনো বাস্তব সেবা চালু হয়নি।

বর্তমান উদ্যোগে কী নতুনতা আছে?

সরকার এবার আগের ভুলগুলো বিশ্লেষণ করে নতুনভাবে কূটনৈতিক ও প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, “আমরা এবার পেপ্যাল সিঙ্গাপুর অফিসে সরাসরি যোগাযোগ করছি, এবং মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমেও সহায়তা চাইছি।”

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা নয়, আর্থিক ও প্রযুক্তিগত প্রস্তুতিও জরুরি। একাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে একটি কার্যকর ও স্বচ্ছ প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা গেলে পেপ্যালের মতো সেবাগুলোর পথ খুলে যাবে।

কীভাবে উপকৃত হবে বাংলাদেশ?

বর্তমানে দেশের প্রায় ৮-১০ লাখ সক্রিয় ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন। তাঁদের বেশিরভাগই আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেসে কাজ করেন এবং পেমেন্ট নিতে হয় নানা ঘুরপথে। পেপ্যাল চালু হলে এসব ফ্রিল্যান্সার খুব সহজেই সরাসরি নিজের একাউন্টে অর্থ আনতে পারবেন, যা সময় বাঁচাবে, ঝুঁকি কমাবে এবং খরচও অনেক কম হবে।

এছাড়া ই-কমার্স উদ্যোক্তা, ডিজিটাল মার্কেটার ও অনলাইন কোর্স বা পণ্য বিক্রি করা ব্যক্তি যারা আন্তর্জাতিক পেমেন্ট নিতে চান, তাদের জন্যও পেপ্যাল একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে।

পেপ্যাল বাংলাদেশে চালু হওয়ার কথা বহুবার শোনা গেছে। প্রতিবারই কিছু আশ্বাসের পর তা মিলিয়ে গেছে বাস্তব জটিলতায়। তবে এই মুহূর্তে দেশের ভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন করে আলোচনায় এসেছে এই আন্তর্জাতিক সেবা। সরকার যদি এবার কৌশলগতভাবে এগোয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যথাযথ যোগাযোগ করে, তাহলে ফ্রিল্যান্সারদের বহু বছরের প্রত্যাশা পূরণ হবার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। এখন সময় বলবে—আলোচনার পর এবার সত্যিই আলোর মুখ দেখবে কিনা বহুল প্রতীক্ষিত পেপ্যাল।

মো: রাজিব আলী/

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ