ঢাকা, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২

জাপানে অনাহারে মৃত্যু, ৪ দিন না খেয়ে ছিলেন বাংলাদেশি তরুণ

বিশ্ব ডেস্ক . ২৪আপডেটনিউজ
২০২৫ জুলাই ০১ ২০:১১:২৫
জাপানে অনাহারে মৃত্যু, ৪ দিন না খেয়ে ছিলেন বাংলাদেশি তরুণ

নিজস্ব প্রতিবেদক: জীবনের শুরুতে যার চোখেমুখে ছিল রঙিন স্বপ্ন—অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বিশ্ব জয় করার আকাঙ্ক্ষা—সেই তরুণ মোহাম্মদ আফরিজি বিন আপনকে শেষবার দেখা গেল একটি কফিনে, নিথর, নিস্পন্দ। সাদা কাফনের চাদরে মোড়ানো তার দেহ যেন সাক্ষ্য দিচ্ছিল, উন্নত দেশেও অনাহারে মরতে হয়, নিঃসঙ্গতায় নিঃশেষ হতে হয়।

২৬ বছর বয়সী এই তরুণ পাড়ি জমিয়েছিলেন জাপানে, ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু প্রযুক্তির স্বর্গে গিয়েও তিনি হারিয়ে গেলেন ক্ষুধার অন্ধকারে, নিঃসঙ্গতার অতল গহ্বরে।

স্বপ্ন যেখানে স্তব্ধ হয়ে যায়

কলেজের কিছু বকেয়া টিউশন ফি—এই সামান্য সংকটই ধীরে ধীরে গ্রাস করেছিল আফরিজির জীবন। আর্থিক অনটনের ঘূর্ণিপাকে পড়ে বন্ধ হয়ে যায় তার বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি আর মোবাইল সংযোগ। ঘর হয়ে ওঠে বন্দিশালা। সেই ঘরেই দিন গুনতে থাকেন তিনি—একাকী, অন্ধকারে, অনাহারে।

জাপানের এক ব্যস্ত শহরের কোণে, এক ছোট্ট ভাড়া বাসায়—মানুষের কোলাহল থেকে অনেক দূরে—নিজেকে হারিয়ে ফেলেন আফরিজি।

“চোখে কিছুই দেখি না”—শেষ বার্তায় কান্না

প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটির সদস্য হাসান রবিন এক হৃদয়বিদারক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন আফরিজির শেষ মুহূর্তের কথা। প্রতিবেশীরা জানায়, টানা ১৫ দিন আফরিজিকে বাসা থেকে বের হতে দেখা যায়নি। কেউ কেউ দরজার সামনে খাবার রেখে যেতেন, কিন্তু সেগুলো থাকত ঠিক আগের জায়গাতেই। দরজা খুলে খাওয়ার শক্তিটুকুও ছিল না তার।

শেষবার তাকে দেখা যায় রান্নাঘরের একটি ছোট জানালার ফাঁক দিয়ে। মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে হতাশ গলায় বলেছিলেন, “চোখে কিছুই দেখতে পাই না।” তখনই জানান, চারদিন ধরে কিছু খাওয়া হয়নি। তার কণ্ঠে ছিল না কোনো অভিযোগ, শুধু ক্লান্তি।

নিয়মের দেয়ালে আটকে থাকা জীবন

জাপানের আইনে অনুমতি ছাড়া বাসার দরজা ভাঙা নিষেধ। তাই তার বন্ধু ও পরিচিতজনেরা ঠিক করেছিলেন, আগামী রবিবার পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস নিয়ে গিয়ে দরজা খুলবেন।

কিন্তু রবিবার আর আসেনি আফরিজির জীবনে। সময়ের আগেই তিনি বিদায় নিয়েছেন, হয়তো অভুক্ত শরীরটাই আর সহ্য করতে পারেনি।

যখন শরীর হয়ে যায় ১০ কেজিরও কম

হাসান রবিন আরও জানান, “যখন পুলিশ তার নিথর দেহ বের করছিল, মনে হচ্ছিল ওজন যেন ১০ কেজিরও কম। পুলিশ বলেছে, শরীর ছিল সম্পূর্ণ শক্ত হয়ে যাওয়া—যেন দীর্ঘদিনের কষ্ট জমে জমে জমাট বেঁধেছিল তার প্রতিটি অস্থিতে।”

শুধু মৃত্যু নয়, এটি এক নীরব প্রতিবাদ

আফরিজির মৃত্যু কেবল একটি জীবন শেষ হওয়া নয়—এটি এক প্রবাসী তরুণের নীরব চিৎকার, যা কেউ শুনতে পায়নি। এ মৃত্যু প্রশ্ন তোলে, কতটা নিঃসঙ্গ হলে একজন মানুষ ক্ষুধা নিয়ে মৃত্যুকে বেছে নেয়? কতটা অবহেলিত হলে দরজার এপারে পড়ে থাকে তার শেষ আর্তি?

জাপানের মতো উন্নত দেশে, যেখানে মানুষ রোবট বানায়, সেখানে এক মানুষ না খেয়ে মরেছে—এ সত্য যতটা অবিশ্বাস্য, তার চেয়ে বেশি লজ্জার।

একজন আফরিজি হারিয়ে গেছেন, কিন্তু আমাদের যেন চোখ খুলে দেন তিনি। প্রবাসে থাকা প্রিয়জনদের খোঁজ নিই, পাশে থাকি। কারণ, একেকটি প্রবাসী জীবন মানে শুধু রেমিট্যান্স নয়—মানে একেকটি স্বপ্ন, সংগ্রাম আর অদৃশ্য কান্না।

মো: রাজিব আলী/

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ