ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২

কোন সময় ঘুমানো সুন্নত, আর কখন ঘুমানো নিষেধ? হাদিসে নির্দেশনা

২০২৫ জুলাই ০৩ ১৩:২৪:৫৫
কোন সময় ঘুমানো সুন্নত, আর কখন ঘুমানো নিষেধ? হাদিসে নির্দেশনা

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঘুম মানুষের জীবনের এক অপরিহার্য অংশ। এটি শুধুমাত্র শারীরিক বিশ্রাম নয়, বরং মানসিক প্রশান্তি এবং দৈনন্দিন জীবনের ভারসাম্য রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে ঘুমের গুরুত্ব, সময় এবং আচার-আচরণ সম্পর্কে পরিষ্কার দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইসলাম ঘুমকে একটি নেয়ামত হিসেবে দেখলেও কিছু নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে নিষেধ বা নিরুৎসাহিত করেছে। আবার কিছু সময়কে সুন্নত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এই প্রবন্ধে হাদিসের আলোকে ঘুমের আদর্শ সময়, সুন্নত ঘুম এবং নিষিদ্ধ বা অনুচিত সময়গুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো।

ঘুম ইসলামে কিভাবে মূল্যায়িত

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“আর তিনি তোমাদের জন্য রাতকে করেছেন আবরণস্বরূপ, বিশ্রামের জন্য নিদ্রা দিয়েছেন এবং দিনকে করেছেন ছড়িয়ে পড়ার সময়।”(সূরা ফুরকান, আয়াত: ৪৭)

আরেক আয়াতে বলা হয়েছে,

“তোমাদের নিদ্রাকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী।”

(সূরা নাবা, আয়াত: ৯)

এই আয়াতগুলো থেকে বোঝা যায়, ঘুম একটি স্বাভাবিক, প্রয়োজনীয় ও দয়ালু স্রষ্টার পক্ষ থেকে উপহার। তবে এরও রয়েছে সময় ও পদ্ধতির বিধান।

কোন সময় ঘুমানো সুন্নত

দুপুরে কায়লুলা করা

হাদিসে মধ্যাহ্নভোজের পর হালকা বিশ্রাম বা ঘুমকে 'কায়লুলা' বলা হয়। এটি নবিজি (সা.)-এর একটি সুন্নত। তিনি নিজেও কায়লুলা করতেন এবং সাহাবাদেরও এ বিষয়ে উৎসাহিত করতেন।

হাদিসে এসেছে,

“তোমরা কায়লুলা করো, কারণ শয়তান কায়লুলা করে না।”

(আল জাওযি, সিফাতুস সাফওয়া)

এই ঘুম দিনের মধ্যভাগে মানসিক স্বস্তি আনে, শরীরকে চাঙ্গা করে এবং বিকালের ইবাদত ও কাজে মনোযোগ ধরে রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। আধুনিক গবেষণাও প্রমাণ করেছে, ২০–৩০ মিনিটের একটি 'পাওয়ার ন্যাপ' দিনের কর্মক্ষমতা বাড়াতে পারে।

রাতে ঘুমানো

রাতকে আল্লাহ তায়ালা নিদ্রার সময় হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। দিন হলো জীবিকা অনুসন্ধানের সময়।“তিনিই স্বীয় রহমতে তোমাদের জন্য রাত ও দিন করেছেন, যাতে তোমরা রাতে বিশ্রাম করো এবং দিনে জীবিকা অন্বেষণ করো।”

(সূরা কাসাস, আয়াত: ৭৩)

রাসুল (সা.) রাতের ঘুমকে খুব গুরুত্ব দিতেন এবং রাতে নির্দিষ্ট সময় ঘুমিয়ে শেষ তৃতীয়াংশে তাহাজ্জুদে উঠতেন।

কোন সময় ঘুমানো নিষেধ বা অনুচিত

ফজরের পর ঘুমানো

রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মতের জন্য সকালবেলা বরকতের দোয়া করেছেন।

اللَّهُمَّ بَارِكْ لِأُمَّتِي فِي بُكُورِهَا

“হে আল্লাহ! আমার উম্মতকে সকালবেলায় বরকত দান করুন।”

(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৬০৬)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন,

“আমার উম্মতের জন্য সকালবেলার সময় বরকতপূর্ণ করে দেওয়া হয়েছে।”

ফজরের নামাজের পর যদি কেউ ঘুমিয়ে পড়ে, সে এই বরকত থেকে বঞ্চিত হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষাতেও বলা হয়, সকালে ঘুমালে শরীরের প্রাকৃতিক রিদম বিঘ্নিত হয়, যার প্রভাব পড়ে স্বাস্থ্য ও মানসিক স্থিরতার ওপর।

আসরের নামাজের পর ঘুমানো

আসরের পর ঘুমানোকে হাদিসে অনুৎসাহিত করা হয়েছে। হাদিসে এসেছে,

“যে ব্যক্তি আসরের পর ঘুমায় এবং এতে যদি তার বুদ্ধি কমে যায়, তবে সে যেন নিজেকে তিরস্কার করে।”

(মুসনাদে আবি ইয়ালা, হাদিস : ৪৮৯৭)

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, আসরের পর ঘুমের কারণে শরীর, মন ও মস্তিষ্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। বর্তমান সময়ের চিকিৎসা বিজ্ঞানও এ সময় ঘুমানোকে মানসিক কার্যক্ষমতার জন্য ক্ষতিকর বলে গণ্য করে।

মাগরিবের পর ও এশার আগে ঘুমানো

মাগরিবের সময় থেকে এশার আগ পর্যন্ত ঘুমানোকে হারাম বলা হয়নি, তবে রাসুল (সা.) এই সময় ঘুমানো অপছন্দ করতেন। কারণ, এতে ইশার নামাজ মিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

সহিহ বুখারিতে এসেছে:

“রাসুলুল্লাহ (সা.) এশার আগে ঘুমানো এবং নামাজের পর অহেতুক গল্প-গুজব অপছন্দ করতেন।”(সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫১৪)

তবে কেউ যদি খুবই ক্লান্ত থাকে, অসুস্থ থাকে বা ঘুমের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তাহলে অল্প সময় ঘুমানো জায়েজ।

ইসলাম ঘুমকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করে

ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপনের ধর্ম। ঘুমের সময়, কাজের সময়, ইবাদতের সময়—সব কিছুর একটি নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করেছে। ঘুমের সময় ও ধরন নির্ভর করে শরীরের চাহিদা ও আত্মার শুদ্ধতার ওপর। অতিরিক্ত ঘুম যেমন আলসেমির জন্ম দেয়, তেমনি ঘুমের অভাব মানুষকে ক্লান্ত করে তোলে।

রাসুল (সা.) এর জীবনচর্চা ছিল সময়ানুগ, পরিমিত ও উদাহরণস্বরূপ। তাঁর ঘুম ও জাগরণের ধরন আমাদের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ।

ঘুম একটি নিয়ামত হলেও তা সময় ও পদ্ধতি মেনে না চললে শরীর, মন ও রুহানিয়াত—তিনেরই ক্ষতি হয়। হাদিসে যেসব সময় ঘুমাতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, তা মূলত মানুষের শারীরিক ও আত্মিক কল্যাণের দিক থেকে বিবেচনা করে।

সুন্নত সময় অনুযায়ী ঘুমের অভ্যাস আমাদের শুধু কর্মক্ষমতাই বাড়াবে না, বরং দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ে উপকার বয়ে আনবে।

FAQ:

১. কায়লুলা কি?

দুপুরে হালকা বিশ্রাম বা ঘুমকে কায়লুলা বলা হয়, যা নবী (সা.)-এর সুন্নত।

২. ফজরের পর ঘুমানো কেন নিষেধ?

ফজরের পর ঘুমালে সকালবেলার বরকত থেকে বঞ্চিত হওয়া যায়, যা হাদিসে নিরুৎসাহিত।

৩. আসরের পর ঘুমানোর ক্ষতি কী?

আসরের পর ঘুমালে মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি কমে যেতে পারে বলে হাদিসে সতর্ক করা হয়েছে।

৪. মাগরিব ও এশার সময় ঘুমানো হারাম?

হারাম নয়, তবে রাসুল (সা.) এই সময় ঘুমানো অপছন্দ করতেন কারণ নামাজ মিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

৫. ইসলামে ঘুমের গুরুত্ব কী?

ঘুম শরীর ও আত্মার জন্য এক নিয়ামত এবং রাতে বিশ্রামের জন্য আল্লাহ নির্ধারিত সময়।

মো: রাজিব আলী/

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ