ঢাকা, রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

চরম বিপদের প্রবাসীরা, অনিশ্চয়তায় বিদেশফেরত চার লাখ কর্মী

প্রবাসী ডেস্ক . ২৪আপডেট নিউজ
২০২০ আগস্ট ২৯ ২০:৩২:৩৪
চরম বিপদের প্রবাসীরা, অনিশ্চয়তায় বিদেশফেরত চার লাখ কর্মী

এই পরিস্থিতিতে তারা কবে বিদেশে কাজে ফিরতে পারবেন, নিশ্চয়তা নেই তার। বিদেশ যেতে না পারলে দেশে কী করবেন, তাও অজানা। বিদেশ যেতে যে টাকা দিয়েছিলেন, তা ফেরত পাবেন কিনা জানেন না তাও।

বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের হিসাবে গত ১ এপ্রিল থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত ৭৮ হাজার ৪৩ জন কর্মী ফেরত এসেছেন বাংলাদেশে। তাদের একটি অংশ ফিরেছেন কারামুক্ত হয়ে কিংবা অবৈধ হয়ে পড়ায় সাধারণ ক্ষমার সুযোগে। বড় অংশ ফিরেছেন কাজ হারিয়ে।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচির প্রাক্কলনে, করোনা মহামারিতে বিমান যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার আগে অন্তত দুই লাখ কর্মী দেশে আসেন, যারা আটকা পড়েছেন।

রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার হিসাবে অন্তত সোয়া এক লাখ কর্মীর বিদেশ যাওয়ার সব প্রক্রিয়া শেষের পথে ছিল। তারা যেতে পারেননি। সব মিলিয়ে চার লাখ কর্মীর জীবন ও জীবিকা অনিশ্চয়তায়।

তাদেরই একজন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর পাশে থাকতে গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর তিন মাসের ছুটিতে সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. ইকবাল হোসেন। ফিরতি বিমানের টিকিটও কাটা ছিল। ২৫ মার্চ সৌদি আরব ফিরে যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু করোনার ‘লকডাউনে’ বিমান চলাচল বন্ধ হওয়ায় ফেরা হয়নি আর। আট মাস ধরে দেশে রয়েছেন। এর মধ্যে জমানো সব টাকা শেষ। ধারদেনা করে চলেছেন কিছুদিন। শেষে উপায়ন্ত না পেয়ে শুরু করেছেন চাষাবাদ।

ইকবাল হোসেনের শেষ মেয়াদ ফুরিয়েছে পাঁচ মাস আগে, ২৬ মার্চ। পরিকল্পনা ছিল সৌদি ফিরে গিয়ে বিমানবন্দর থেকেই ভিসা নবায়ন করবেন। তিনি সেখানে একটি ‘থার্ড পার্টি’ রক্ষণাবেক্ষণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। আট মাসে কাজে অনুপস্থিত থাকায় চাকরি আছে না নেই, তাও জানেন না। যোগাযোগ করেও সাড়া পাচ্ছেন না।

‘করোনায় দেশে আটকেপড়া প্রবাসী কর্মীদের ভিসা ফুরালে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন এ আশ্বাসের বাণী শোনালেও আশ্বস্ত হতে পারছেন না ইকবাল হোসেন।

প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, যারা ফিরতি বিমানের টিকিট কেটে বা বুকিং দিয়ে দেশে ফিরেছেন, তাদের ভাড়া নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই। আগের ভাড়াতেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যেতে পারবেন বিমান যোগাযোগ স্বাভাবিক হলে। তবে ইকবাল হোসেন জানালেন, তিনি জানতে পেরেছেন এখন যারা বিশেষ বিমানে যাচ্ছেন, তারা তিন-চারগুণ বেশি ভাড়ায় বিদেশ যাচ্ছেন। এত টাকা খরচ করে যাওয়ার মতো অবস্থা তার নেই। সঞ্চিত সব টাকাই শেষ।

মালয়েশিয়ায় লকডাউন শুরুর পর গত ১১ মার্চ দেশে ফেরেন মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের সাব্বির হোসাইন। দেশটিতে তিন বছর ছিলেন তিনি। মালয়েশিয়ায় যে প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে গিয়েছিলেন, তা বদল করে বেশি বেতনে যে কাজ পেতেন, তাই করতেন। এ হিসেবে তিনি কাগজবিহীন কর্মী। কাজ না থাকায় দেশে ফিরে আসেন তিনি। বিমান যোগাযোগ স্বাভাবিক হলেও বিদেশে গিয়ে কাজ পাবেন, তার নিশ্চয়তাও নেই। আবার মালয়েশিয়ায় গিয়ে ১৪ দিন নিজ খরচে ‘কোয়ারেন্টাইনে’ থাকতে হবে। সব মিলিয়ে খরচ হবে এক-দেড় লাখ টাকা। কাজ হারিয়ে তার পক্ষে এত টাকা খরচ করে বিদেশ যাওয়া সম্ভব নয় আর। তাই দেশে ‘কিছু একটা’ করার চেষ্টা করছেন।

বিদেশে ফেরত কর্মীদের পুনর্বাসনে ৭০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়েছে। ‘বিনা জামানতে’ ঋণ দিতে এর ২০০ কোটি টাকার প্যাকেজও ঘোষণা করা হয়েছে। ৪ শতাংশ সরল সুদে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ সুবিধা পাওয়া যাবে। অন্তত সরকারি ঘোষণা তেমনই। সাব্বির হোসাইন এসব ঘোষণা শুনে দোকান করার পুঁজির খোঁজে ঢাকার দোহারের প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের শাখায় গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, পাঁচ লাখ নয়, সর্বোচ্চ এক লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিনা জামানতে ঋণ পাওয়া যাবে। বাকিটার জন্য জামানত লাগবে। সাব্বির হোসাইন প্রবাসমেইল-কে বলেছেন, জামানত দেওয়ার সামর্থ্য থাকলে কী আর ঋণের জন্য যেতেন!

ইকবাল, সাব্বিরের চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছেন ময়মনসিংহ সদরের বয়রার তরুণ বদরুল নূর। তিনি ইলেকট্রিক কাজের প্রশিক্ষণ শেষে সিঙ্গাপুর যেতে স্থানীয় আদম ব্যাপারির মাধ্যমে রিক্রুটিং এজেন্সিকে আড়াই লাখ টাকা দিয়েছিলেন। এর মধ্যেই এক লাখ টাকা সুদে ঋণ করে দিয়েছেন তার বড় বোন। বাকি দেড় লাখ টাকা ধানের জমি বন্ধক রেখে দিয়েছিলেন। মার্চে তার বিমানে চড়ার কথা ছিল। ছয় মাস হতে চলল বিমানই চালু হচ্ছে না। বদরুল জানেন না, বিমান চালু হলেও তার সিঙ্গাপুর যাওয়া হবে কিনা। কিন্তু এদিকে সুদে নেওয়া ঋণের টাকার চাপে আছেন। বড় বোন টাকার জন্য তাগিদ দিচ্ছেন। টাকার জন্য বোনের সংসারে শুরু হয়েছে অশান্তি। চাষের জমিও হাতছাড়া হয়েছে। যে ব্যাপারি টাকা নিয়েছিলেন, আরও অনেকের টাকা ফেরতের চাপে পড়ে সেও লাপাত্তা।

করোনাকালে এমনও লাখো ইকবাল, সাব্বির, বদরুল অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন। যারা দেশে ফিরেছেন তারা জানেন না, আবার কবে বিদেশে কর্মস্থলে ফিরতে পারবেন। ফিরলেও সেখানে চাকরি ফিরে পাবেন কিনা তার নিশ্চয়তাও নেই। অনেকের কর্মস্থল করোনার ধাক্কায় বন্ধ হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। যারা কাজ হারিয়ে দেশে ফিরেছেন, তারা জানেন না দেশে কী করবেন? কী করে পেটে ভাত জোগাড় করবেন? যারা সব প্রক্রিয়া শেষ করে বিদেশ যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন, তারা জানেন না কোনো দিন আর বিদেশ যাওয়া হবে কিনা তাদের! আর যেতে না পারলে, যে টাকা দিয়েছেন তা ফেরত পাবেন কিনা।

অভিবাসন নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থা বলছে, এই চার লাখ মানুষের কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসন বিরাট চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশি কর্মীদের ফেরত না পাঠিয়ে অন্য খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে অনুরোধ জানিয়ে ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর যৌথ স্বাক্ষরে বিভিন্ন দেশকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ফেরত আসা কর্মীদের পুনঃপ্রশিক্ষণ দিয়ে আবার বিদেশ পাঠানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ।

অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সি আর আবরার বলেছেন, ‘করোনা বলেকয়ে আসেনি। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তা কেউ বলতে পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় জোগান ‘রেমিট্যান্স’ ঠিক রাখতে হলে প্রবাসীদের সুরক্ষায় কূটনৈতিক, মানবিক, সামাজিক, আর্থিকসহ যতভাবে সম্ভব কর্মীদের সহায়তা করতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ স্বাভাবিক হলেও বাংলাদেশ এখনও বিচ্ছিন্ন; এর কারণ বাংলাদেশের করোনা পরীক্ষার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দেশে নেগেটিভ আসা ১৫১ কর্মী ইতালিতে গিয়ে করোনা সন্দেহে প্রবেশ করতে না পেরে ফেরত এসেছেন। তাই করোনার বিশ্বাসযোগ্য পরীক্ষা করে কর্মী পাঠাতে হবে, যাতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন না থাকে বাংলাদেশ। যোগাযোগ উন্মুক্ত হলে কর্মীরা ফিরে যেতে পারবেন। পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে, যাতে কর্মী ফেরত না আসে।’

ইমরান আহমদ বলেন, এ সংকট বৈশ্বিক। দেশে এসে যারা আটকা পড়েছেন, তারা দেশেই কাজ পান কিনা তা দেখা হচ্ছে। কর্মসূচি তৈরি করা হচ্ছে। তারা যাতে ঋণ নিয়ে কাজ শুরু করতে পারেন, সেজন্য সরকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।

প্যাকেজের ঋণ পাওয়া কতটা সহজ- তা জানতে সোমবার প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ঋণ বিতরণ শাখায় যোগাযোগ করা হয়। মুন্সীগঞ্জের সাব্বির হোসেনের অভিযোগ ছিল, তাকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিনা জামানতে ঋণ দেবে বলে দোহার শাখা জানিয়েছে। এর জবাবে ব্যাংকের ঋণ সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট (ঋণ ও অগ্রিম) মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেছেন, ‘দুই লাখ টাকা পর্যন্ত বিনা জামানতে দেওয়া হবে। পশু পালন, কৃষি, ক্ষুদ্র মাঝারি, ব্যবসাসহ ৩৭টি খাতে ঋণ দেওয়া হবে।’

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ



রে